২০০৫ সালে রূপালী পর্দায় মুক্তি পায় কনস্ট্যানটিন। সিনেমাটি ডিসি কমিকসের হেলব্লেজারের মূল চরিত্র অবলম্বনে তৈরি করা।
যে সময়ের কথা বলছি, তখনও কমিক চরিত্র অবলম্বনে তৈরি হওয়া সিনেমা নিয়ে বিশ্বে উন্মাদনা তৈরি হয়নি। পুরো বিশ্বে এটি নিয়ে তোলপাড়ও ছিল না। কিন্তু তারপরও সিনেমাটি দাগ কেটে যায় বহু মানুষের অন্তরে।
এ এক অসাধারণ সিনেমা। যেটি সুপারহিরো ঘরানার বাইরে দাঁড়িয়ে নিজস্ব পরিচয় তৈরি করেছিল। এখানে কোনো উড়ন্ত সুপারম্যান নেই, নেই বর্ম পরিহিত প্রযুক্তি-নির্ভর ব্যাটম্যান বরং রয়েছে এক চেনা মানুষের যন্ত্রণাময়, অতিপ্রাকৃত লড়াই। কিয়ানু রিভস অভিনীত জন কনস্ট্যানটাইন একজন ধর্মীয় বিশ্বাসে টালমাটাল, আত্মনিগৃহীত এক্সরসিস্ট, যিনি স্বর্গ-নরক আর এই পৃথিবীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছেন নিজের আত্মা ও ভবিষ্যতের জন্য।
মজার ব্যাপার হলো, যারা আগে থেকে ডিসি কমিকসের ভক্ত, তারা চরিত্রটির সঙ্গে পরিচিত থাকলেও পর্দায় কনস্ট্যানটিনকে দেখে ব্যাপক ধাক্কা খান। কারণ কমিকসের কনস্ট্যানটিনের চুল ছিল সোনালী রংয়ের, আর গায়ে থাকতো বাদামী রংয়ের ওভারকোট। কিন্তু পর্দায় দেখা যায় কিয়ানু রিভসের কালো চুল, আর কালো ওভারকোট।
তবে চরিত্রের বাহ্যিক রূপ দেখে সবাই খানিকটা ধাক্কা খেলেও কিয়ানু রিভসের অভিনয় পুরোপুরি মাত্রায় সব পুষিয়ে দেয়। আফসোস হলো, মুক্তির সময় সিনেমাটি বক্স অফিসে তেমন রমরমা ব্যবসা করেনি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি হয়ে উঠতে শুরু করে কাল্ট ক্লাসিক।
দর্শকরা এতে খুঁজে পেয়েছিলেন এক ডার্ক অথচ মানবিক অ্যান্টি-হিরোর গল্প, যেখানে ধর্ম, দার্শনিকতা, অতিপ্রাকৃত ও বাস্তব এক সুতোয় গাঁথা ছিল। বিশেষ করে গা ছমছমে পরিবেশ, থিওলজিকাল সাবটেক্সট এবং কিয়ানুর ক্যারিশমাটিক উপস্থিতি সব মিলিয়ে কনস্ট্যানটিন গেঁথে যায় বহু মানুষের হৃদয়ে।
একদিকে কমিকস ভক্তরা খুঁজে পান তাদের নিখুঁত কনস্ট্যানটিনকে। অন্যদিকে যারা হেলব্লেজারের সঙ্গে পরিচিত নন। তারাও এটি দেখে মুগ্ধ হন। কিয়ানু রিভসের শীতল অভিনয়, অভিব্যক্তি তাদের সামনে খুলে দেয় এক নতুন দুয়ার।
এরপর শুরু হয় প্রতীক্ষার পালা- কবে আসবে দ্বিতীয় পর্ব? সে অপেক্ষা আর কাটে না। একটি দুটি করে বছর পার হতে হতে কেটে গেছে ২০ বছর! এখনও আসেনি কনস্ট্যানটিন সিনেমার দ্বিতীয় কিস্তি।
কেন সিক্যুয়েলের জন্য ২০ বছরের অপেক্ষা
এই সিনেমার সিক্যুয়েল নিয়ে আলোচনা বহুদিন ধরেই চলছিল। কিয়ানু রিভস নিজেও বহুবার প্রকাশ্যে বলেছেন যে, তিনি জন কনস্ট্যানটাইন চরিত্রে আবার ফিরতে চান। ২০২২ সালে সিনেমাটির প্রযোজনা সংস্থা ওয়ার্নার ব্রাদার্স ও ডিসি আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় যে, তারা কনস্ট্যানটিন ২ নিয়ে ভাবছে। সিনেমার প্রজেক্টে যুক্ত করা হয় পরিচালক ফ্রান্সিস লরেন্স ও স্ক্রিনরাইটার আকিবা গোল্ডসম্যানকেও।
২০২৩ সালের দিকে তারা একটি সম্ভাব্য স্টোরিলাইন ডিসি স্টুডিওসের কাছে নিয়ে যায়। গল্পটা প্রাথমিকভাবে পছন্দও হয় সবার। সংশ্লিষ্টরা কাজ শুরু করে দেন চিত্রনাট্য নিয়ে।
কিয়ানু এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা একটি গল্প সামনে নিয়ে এসেছি… তারা পছন্দ করেছে….. আর এখন আমরা চিত্রনাট্য লেখার কাজ করছি।” ভক্তদের আশা আবারও নতুন করে জেগে ওঠে।
কিন্তু ২০২৫ সালে এসে প্রকল্পটি ‘ক্রিয়েটিভ ডিফারেন্স’ এর কারণে স্থবির হয়ে যায়। মূলত এই মতপার্থক্যই প্রধান কারণ।
কিয়ানু রিভস চান, চরিত্রটির মূল সারতত্ত্বটি রক্ষা হোক। এটিতে অযাচিত অ্যাকশন না ঢুকুক। মানসিক টানাপোড়েনটা স্পষ্টভাবে থাকুক। সে সঙ্গে থাকুক ধর্মীয়-সাইকোলজিক্যাল গল্প।
অন্যদিকে স্টুডিও চাইছে বিরাট আয়োজন। চোখ ধাঁধানো সব টুইস্ট।
ডিসি’র নতুন দর্শন: বাধা না সম্ভাবনা?
২০১২ সালে যাত্রা শুরু করেছিল ডিসিইইউ (ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্স)। মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের মতো কিছু একটা করতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু দিনশেষে গোটা ডিসিইইউ হয়ে যায় বিশৃঙ্খল। সব সিনেমাকে এক সুতায় গাঁথতে তারা ব্যর্থ হয়। ফলে এই ইউনিভার্সকে তৈরি হওয়া সিনেমাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই নিজস্ব স্বর খুঁজে পায়নি।
এসব কারণেই ২০২২–২৩ সালের দিকে জেমস গান ও পিটার সাফ্রান যৌথভাবে ডিসি স্টুডিওসের-এর দায়িত্ব নেন এবং ঘোষণা করেন যে নতুন যুগের সূচণা হতে চলেছে। আর তা হবে- ‘গডস অ্যান্ড মনস্টারস’।
নতুন পরিকল্পনা হলো – একক চরিত্রের বদলে যুক্তি ও গল্পের মাধ্যমে ইন্টার-কানেক্টেড ইউনিভার্স গড়ে উঠবে। কিন্তু গোলমাল বাঁধে অন্য জায়গায়। এর ফলে কনস্ট্যানটিনের মতো ডার্ক, আত্মবিশ্লেষণধর্মী গল্পের জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে যায়।
ডিসি ইউনিভার্সের মূল চরিত্র যেখানে সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, সুপারগার্ল, এবং স্বল্প পরিচিত কিন্তু শক্তিশালী চরিত্র, সেখানে কনস্ট্যানটিন যেন ঠিক খাপে খাপ মিলছে না।
জেমস গান চাইছেন ডিসি ইউনিভার্সে সবকিছু নিয়মতান্ত্রিকভাবে হবে। কনস্ট্যানটিনের মতো ব্যতিক্রমী বা পুরোনো টাইমলাইনগুলো ‘এলসওয়ার্ল্ডস’ নামে থাকবে। তাদের স্থান ও গুরুত্বও হবে সীমিত।
জেমস গান অবশ্য হেলব্লেজারকে বাদ দিচ্ছেন না। তিনিও চাচ্ছেন কনস্ট্যানটিকে রাখতে। কিন্তু কিয়ানু রিভস ও দর্শকরা যেভাবে চাইছেন, সেভাবে হয়তো তিনি ভাবছেন না। যা-ই হোক, তিনি একটি ডার্ক এবং ম্যাজিক-বেইজড প্রজেক্ট ভবিষ্যতে আসতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সবমিলিয়ে এরকম পরিস্থিতিতে কনস্ট্যানটিন-২ এর ভবিষ্যৎ এখনো অস্পষ্ট। তবে আশার কথা হলো- কিয়ানু এখনও রাজি এ চরিত্রে ফিরতে।
কিয়ানুর একনিষ্ঠতা বনাম ডিসি’র দৃষ্টিভঙ্গি
এক সাক্ষাৎকারে কিয়ানু বলেছিলেন, ‘আমি জন কনস্ট্যানটিন চরিত্রটিকে ভালোবাসি। আমি ওয়ার্নার ব্রাদার্স এবং ডিসিকে অনেকবার অনুরোধ করেছি যেন তারা আমাকে আবার সেই চরিত্রে ফিরতে দেয়। আমরা কথা বলেছি, আশাও জেগে উঠেছিল, কিন্তু সবকিছু আপাতত স্থগিত অবস্থায় রয়েছে।’
জন কনস্ট্যানটাইন এমন একটি চরিত্র, যাকে নিয়ে কিয়ানু রিভসের ভালোবাসা নিঃসন্দেহে গভীর। তিনি চান এই গল্পটি থাকুক আত্মা ও নৈতিকতার প্রশ্নে ঘেরা এক আধার-জগতের মতো। যেখানে মূল চরিত্রের ভেতরে ক্রমাগত চলবে অন্তর্দ্বন্দ্ব, কিন্তু সে হবে নির্ভীক।
কিয়ানু রিভস কোনোভাবেই চান না এটিকে জন উইক সিনেমার মতো মারামারি ও অ্যাকশন দিয়ে ভরিয়ে তুলতে। বরং তিনি চান- সিনেমাটি ব্যতিক্রমী, থমথমে, এবং দর্শকের ভাবনার জায়গায় নাড়া দেওয়ার মতো হবে। সবাই অনুভব করবে কনস্ট্যানটিনের টানাপোড়েন।
ভক্তরা কী বলছে?
এদিকে, ভক্তরা তো অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের সে অপেক্ষাকে সম্মান জানিয়ে যখনই কনস্ট্যানটিন ২ এর সম্ভাবনা আসে, তখনই দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমে সবাই সরব হয়ে উঠেছে। ভক্তদের কথা হলো – গল্প পরে, আগে আমরা কিয়ানুকে এই চরিত্রে চাই। ফলে স্টুডিও যে কিয়ানুকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে চরিত্রটি করাবে, সে পথও খোলা নেই।
সবমিলিয়ে ভক্তদের এরকম চাপ ও কিয়ানুর কারণে প্রকল্পটি পুরোপুরি বাতিলও হচ্ছে না। আবার এটি শুরুও হচ্ছে না।
বর্তমানে প্রকল্পটিার অবস্থা হচ্ছে গল্প জমা হয়েছে ও প্রাথমিকভাবে নেওয়া হয়েছে। চিত্রনাট্যের কাজও ধীরলয়ে চলছে। তবে ডিসি কোনো সবুজ সংকেত দিচ্ছে না। কিয়ানুর নিজস্ব চিন্তাভাবনা, আর ডিসির নতুন ইউনিভার্স সুতা মেলাতে পারছে না। সব কিছু আপাতত সময়ের ওপরই নির্ভর করছে।
ভক্তরা এখনো অপেক্ষায় রয়েছে যে হয়তো একদিন কনস্ট্যানটিন ফিরবে। আরও একবার অন্ধকারের দরজা খুলে যাবে।
তবে কোনো কারণে যদি জন কনস্ট্যানটিন না-ও ফেরে, তারপরও এটি রয়ে যাবে দর্শকের মণিকোঠায়।
উইজ বাল্বের জন্য লেখাটি লিখেছেন: রাজা জহুর খান
আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।