কী ঘটেছিল সামুরাইদের ভাগ্য

কী ঘটেছিল সামুরাইদের ভাগ্যে?

সময়টা ছিল হেইয়ান যুগ, প্রায় এক হাজার বছর আগে। জাপানের রাজা-জমিদাররা তখন রাজপ্রাসাদে ব্যস্ত, আর তাদের জমি পাহারা দিচ্ছে তরবারি হাতে একদল যোদ্ধা। যারা সামুরাই নামেই বেশি পরিচিত। এই্ যোদ্ধাদের চোখে মুখে দৃঢ়তা, জীবনের একমাত্র লক্ষ্য প্রভুর আনুগত্য।

আজকের জাপানে হয়তো আর তাদের দেখা যায় না, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তারা এক অবিচ্ছেদ্য নাম। ঘুরেফিরে আধুনিক সময়ের সিনেমায়, গল্প, কবিতায় তাদের নাম আসে।

এই যোদ্ধা দলের অস্তিত্ব শুরু হয়েছিল পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এরা হয়ে উঠেছিল রাজনীতি, সংস্কৃতি, এমনকি কল্পনায়ও বীরত্বের প্রতীক। যুদ্ধের মাঠেও ব্যাপক দাপট ছিল তাদের। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম মোড়ে তারাই একদিন হয়ে গেল শুধু গল্প- ‘এক যে ছিল বীর…’ ধাঁচের।

সামুরাই নামেই ছিল ভয়

সামুরাই শব্দের মানে ছিল “সেবা করা”। কিন্তু তাদের চেহারা, চালচলন, প্রশিক্ষণ, সবই ছিল ভয়ংকর। তাদের সঙ্গে থাকতো দুই তরবারি। দীর্ঘটাকে বলা হতো কাতানা, আর ছোটটাকে ডাকা হতো ওয়াকিজাশির। এই দুই জোড়া নিয়ে ঘুরতেন তারা। কঠিন নিয়মও অনুসরণ করতেন। সে কঠিন নিয়ম পরিচিত ছিল ‘বুশিদো’ নামে। এই বুশিদো ছিল বেঁচে থাকার চেয়ে মরতে শেখার দর্শন। নিজের প্রভুর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকতেন সবসময় সামুরাই যোদ্ধারা।

যখন যুদ্ধ থেমে যায়, অস্ত্র বেকার হয়ে পড়ে

যুদ্ধ ছিল সামুরাইদের বহুদিনের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু ১৬০৩ সালে শুরু হওয়া টোকুগাওয়া শোগুনাত সবকিছু পালটে দেয়।

টোকুগাওয়া শোগুনাত প্রতিষ্ঠার পর জাপান প্রবেশ করে দীর্ঘ এক শান্তির যুগে। এ যুগকে বলা হতো এডো যুগ (১৬০৩–১৮৬৮)। এ সময় যুদ্ধ নেই, বিদ্রোহও খুবই কম। এই শান্তি সাধারণ মানুষের জন্য আশীর্বাদ হলেও, সামুরাইদের জন্য ছিল বিরাট এক ধাক্কা। শত শত বছর ধরে যুদ্ধ করা এই যোদ্ধাদের হঠাৎ করে খুঁজে নিতে হয় জীবনের নতুন মানে।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৬৩৭ সালে শিমাবারা বিদ্রোহ ছিল সে সময়ের শেষ বড় সামরিক সংঘর্ষ, যেখানে আমাকুসা শিরো নামে এক খ্রিস্টান সামুরাই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে বিদ্রোহ দমন হয় নৃশংসভাবে। এর পরপরই শোগুন ইএমিৎসু জাপানের দরজা বন্ধ করে দেন বাইরের দুনিয়ার জন্য, চালু করেন ‘সাকোকু’ নামক স্বনির্ভর নীতিমালা।

এই নীতিই মূলত সামুরাইদের অস্তিত্বকে ধীরে ধীরে বিলীনের দিকে নিয়ে যায়। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও বিপদে পড়ে যায় সামুরাই শ্রেণি। যারা একসময় যুদ্ধ করেই জীবিকা চালাতেন, তারা হঠাৎ করে হয়ে পড়লেন অচল। অনেকে চাকরি হারিয়ে হয়ে গেলেন রোনিন—যার অর্থই “তরঙ্গের মানুষ”। নিয়ন্ত্রণহীন, গন্তব্যহীন, প্রভুহীন যোদ্ধা।

রোনিন—আবেগের গল্প, বাস্তবের কষ্ট

রোনিনদের নিয়ে জাপানি কল্পনায় তৈরি হয়েছে অনেক সাহসিকতার কাহিনি। সবচেয়ে বিখ্যাতটি স্থান পেয়েছে রূপালী পর্দায়ও। সে গল্প ৪৭ রোনিনের প্রতিশোধ নেওয়ার কাহিনী শোনায়

গল্পটি অনেকটা এরকম – প্রভু আসানো নাগানোরিকে অপমানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেন এক কর্মকর্তা, কিরা ইয়োশিনাকা। এক বছর অপেক্ষা করে, সেই ৪৭ রোনিন প্রতিশোধ নেয়। এরপর তারা নিজেরাও সেপ্পুকু—অর্থাৎ আত্মহত্যা করে প্রভুর প্রতি শেষ আনুগত্য দেখান।

গল্পের দিক থেকে অসাধারণ। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল অনেকটাই ভিন্ন। সে সময় রোনিনদের অনেকেই হয়ে উঠেছিলেন দিনমজুর, দেহরক্ষী, আবার কেউবা হয়ে উঠেছিলেন এক দল ভাড়াটে যারা নগরের নানা অপরাধে যুক্ত থাকতেন।

মুসাশির গল্প—যিনি হেরে যাননি কখনো

শান্তিপূর্ণ সমাজে তরবারি চালানো নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কেবল আত্মরক্ষায় অনুমতি ছিল। তাই সামুরাইরা তৈরি করলেন নতুন কৌশল, ইআইজুৎসু—যেখানে চোখের পলকে কাতানা বের করে আঘাত হানা হয়। মূলত অপর পক্ষকে প্রথমে আঘাত হানতে উসকে দেওয়া হতো এ কৌশলে।

এই সময় সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন মিয়ামোতো মুসাশি। সামুরাইদের শেষ উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন তিনি। বলা হয়, জীবনে ৭০টিরও বেশি দ্বন্দ্বে লড়েছেন এই মিয়ামোতো মুসাশি, কিন্তু একটিতেও হারেননি। নিজের লড়াইয়ের কৌশল গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তার দুই হাতে থাকতো দুটি তরবারি, দুটোই চলতো অদ্ভুত ছন্দে। তার লেখা ‘গোরিন নো শো’ এখনো মার্শাল আর্ট চর্চাকারীদের কাছে বাইবেলের মতো।

মুসাশি প্রভুহীন ছিলেন, মানে তিনিও রোনিন ছিলেন। কিন্তু তিনি অপরাধের পথে না গিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন যে সততা ও সাধনায় একজন সামুরাই যোদ্ধা কী হতে পারেন।

এডো নগরীতে বিলাসিতা, আর গোপনে পতন

রাজধানী এডো (বর্তমান টোকিও) তখন ফুলে ফেঁপে উঠছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি, লোকসংখ্যা—সবই বেড়ে চলেছে। সামন্ত প্রভু দাইমিওরা থাকতেন রাজধানীতে। তাদের সঙ্গেও থাকতো শত শত বেতনভোগী সামুরাই। কিন্তু এদের অনেকেই শুধু নামেমাত্রই চাকরি করতেন, আর বাকিটা সময় কাটাতেন মদের দোকান আর ইওশিওয়ারা নামের আনন্দবিহার এলাকায়। বলে রাখা ভালো, ইওশিওয়ারা ছিল তৎকালীন জাপানের আইনসম্মত রেড-লাইট ডিস্ট্রিক্ট।

সামুরাইদের ব্যবসা করা নিষিদ্ধ ছিল। ফলে অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়তেন বণিক শ্রেণির কাছে। এমনকি কেউ কেউ নিজের তরবারি বিক্রি করে দিতেন।

সবাই কি সে সময় অবক্ষয়ে ডুবেছে?

না। সব সামুরাই যে পতনের পথে গিয়েছিলেন, তা নয়। একজনের কথা তো আগেই বললাম।  তো আগেই বনিষিদ্ধ ছিল,ু বাস্তব চিত্র কেউ কেউ আবার শিল্প-সাহিত্যেও অনন্য দৃষ্টান্ত গড়েছেন। যেমন, জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত হাইকু কবি মৎসুও বাশো। তরবারি ছেড়ে কলম তুলে নেন। তার হাতে হাইকু কবিতা পায় নতুন প্রাণ—প্রকৃতি, মৌনতা আর মুহূর্তকে বন্দি করার এক গভীর কৌশল।

চিত্রশিল্পী ওয়াতানাবে কাজান আর কাওয়ানাবে কিয়োসাই নিজেরা ছিলেন সামুরাই পরিবারের সন্তান, কিন্তু কাজ করেছেন ইউরোপীয় বাস্তবধর্মী চিত্রকলায় এবং পরবর্তীতে জাপানি মাঙ্গার পথপ্রদর্শক হিসেবেও।

অপরাধ আর ঐতিহ্যের মিলন—ইয়াকুজা

সামুরাই সংস্কৃতির ছায়ায় জন্ম নেয় জাপানি মাফিয়া ইয়াকুজা। যাদের কাণ্ডকীর্তি আজো রোমাঞ্চকর উপাখ্যানে স্থান পায়। আসলে রোনিনদের একাংশ সংগঠিত হয়ে গ্যাং গড়ে তুলেছিল বিভিন্ন সময়। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক বিকৃত বুশিদো। সে নীতিমালায় আত্মত্যাগ, শাস্তি হিসেবে আঙুল কাটা, শরীরে উল্কি, সম্মান রক্ষা ইত্যাদি অনেক প্রথা অন্তর্ভুক্ত হয়। এটাকে বলা যায় অনেকটা সামুরাই রীতির আধুনিক অপরাধ সংস্করণ হিসেবে।

শেষ অধ্যায়

সামুরাইরা আজ শুধু স্মৃতি। সিনেমায়, কবিতায়, কমিক বইয়ে তারা আছেন। কখনো বীর, কখনো বিদ্রোহী, কখনো দুঃখী হিসেবে। কিন্তু বাস্তবে তারা হারিয়ে গেছেন এক সুনির্দিষ্ট সময়ের সঙ্গে। যুদ্ধ থেমেছে, প্রভু নেই, বুশিদোও পরিণত হয়েছে শুধুই বইয়ের পৃষ্ঠায়।

তবু তাদের জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সম্মান আর আনুগত্য একদিন অস্ত্রের চেয়েও ভারী ছিল।

তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।