হলিউডের জনপ্রিয় যে পাঁচ সিনেমা ব্যর্থ হয়েছিল বক্স অফিসে

ভালো সিনেমার সংজ্ঞা কী? কোনো সিনেমা যদি মুক্তির পরপরই তা দেখার জন্য দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তাহলেই কী তা ভালো সিনেমা? ইতিহাসে এমন অনেক নজির আছে যে – কোনো সিনেমা মুক্তির পর তা দর্শক দেখেনি, হলে ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তীতে সে-ই সিনেমাই হয়ে উঠেছে কালজয়ী। মানুষ যে শুধু ওই সিনেমা দেখেছে তা নয়, বছরের পর বছর ধরে সে সিনেমা নিয়ে আলাপ হয়েছে। এমনকি ফিল্ম স্কুলেও পড়ানো হয়েছে।

এরকম সিনেমার আলাপ করতে গেলে অনেক নাম নেওয়া যাবে। তবে আজ শুধু বাছাই করে পাঁচটি সিনেমার কথা বলব, যেগুলো শুরুতে হলে ভালো ব্যবসা না করেও পরবর্তীতে জয় করে নিয়েছে দর্শকদের মন।

১. সিটিজেন কেইন (১৯৪১)

সিটিজেন কেইন মুক্তি পায় ১৯৪১ সালে। একে বলা হয় পরিচালক অরসন ওয়েলসের অনবদ্য সৃষ্টি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফিল্ম স্কুলের পাঠ্যসূচীতেও আছে এ সিনেমা। অথচ এই সিনেমাটিই মুক্তির পর দর্শক দেখেনি। সিনেমাটি যে বাজেটে তৈরি হয়েছিল, সে বাজেটও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উল্টো আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল।

যারা সিটিজেন কেইন সিনেমাটির নামের সঙ্গে একেবারেই পরিচিত নন, তাদের জন্য বলছি – এই সিনেমার কাহিনী এগোয় প্রকাশনা জগতের টাইকুন চার্লস ফস্টার কেইনের জীবনকে কেন্দ্র করে। সিনেমার শুরুর ভাগেই দেখা যায় চার্লস ফস্টার কেইন মারা যাচ্ছেন। আর মৃত্যুর আগে তিনি শেষবারের মতো বলে উঠেন ‘রোজবাড’। এই রোজবাড কী? খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু? কেন তিনি এটির নাম নিলেন? এই জবাব খুঁজতে নেমে পড়েন সাংবাদিকরা। আর এর মধ্য দিয়ে দর্শক দেখতে পান চার্লস ফস্টার কেইনের জীবন।

সিটিজেন কে্ইন

ধীরগতির এই সিনেমাটি মুক্তির পর ক্ষতি হয়েছিল ১ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। বর্তমানের হিসেবে তা দাঁড়াবে ৩০ লাখ ডলারের কাছাকাছি। অথচ সিনেমাটি পরে হয়ে উঠেছে কালজয়ী ও অবশ্যপাঠ্য।

বর্তমানে সিনেমাটির আইএমডি রেটিং ১০-এর মধ্যে ৮.৪।

২. ইটস আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ (১৯৪৬)

ইটস আ ওয়ান্ডারফুল লাইফকে বলা হয় বড়দিনের সিনেমা। যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিসমাসের সময় এ সিনেমা টিভিতে দেখানো ও সেখানের মানুষের এটি দেখা – অনেক অলিখিত রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটা সময়। খুবই সাদামাটা গল্প, কিন্তু দর্শক দেখার পর একটি আলাদা ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে উঠেন।

একদম সংক্ষেপে বললে, এক হতাশ ব্যক্তির জন্য স্বর্গ থেকে দেবদূত এসে হাজির হন এবং দেখান যে ওই ব্যক্তি যদি পৃথিবীর বুকে না থাকতেন, তাহলে সবার জীবন কেমন হতো। এক কথায় অসাধারণ গল্প। সিনেমাটির পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক কাপ্রা।

ইটস আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ

তবে এই ফ্র্যাঙ্ক কাপ্রার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল সিনেমাটি মুক্তির পর। এটি তৈরিতে অনেক খরচ হয়েছিল। কিন্তু মুক্তির পর সে বাজেট উদ্ধার করতে পারেনি সিনেমাটি। এটির কপালে পাঁচটা অস্কার নমিনেশন জোটা স্বত্ত্বেও ক্ষতি হয়েছিল পাঁচ লাখ ২৫ হাজার ডলারের।

ঘটনা ঘুরে যায় ১৯৭৬ সালে এসে। ওই বছর থেকে সিনেমাটি টিভিতে দেখানো শুরু হয়। দেখা যেতো প্রতিবছর ক্রিসমাস এলেই টিভিতে এটি সম্প্রচারিত হচ্ছে। তখন দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে এটি। এভাবেই সিনেমাটি পরিণত হয় কালজয়ীতে।

সিনেমাটি যখন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে যায়, তখন ফ্র্যাঙ্ক কাপ্রা নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার অবস্থা হয়েছে ওই বাবা-মায়ের মতো, যাদের সন্তান বড় হয়ে প্রেসিডেন্ট হয়ে যায়।’

সিনেমাটির আইএমডিবি রেটিং ৮.৬।

৩. দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন (১৯৯৪)

বক্স অফিসে ভালো করতে না পেরেও কালজয়ী হওয়ার তকমা ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশনের’ বেলাতেও খাটবে। এই সিনেমাটি এখন আইএমডিবির শীর্ষ ২৫০-এর তালিকার ১ নম্বরে রয়েছে। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক স্টিফেন কিংয়ের ছোটগল্প ‘রিটা হেওয়ার্থ অ্যান্ড শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ থেকে সিনেমাটি তৈরি। পরিচালনা করেছেন ফ্র্যাঙ্ক ডারাবন্ট।

সিনেমার গল্পের সঙ্গে মূল ছোট গল্পের কিছুটা ফারাক আছে। সিনেমার গল্পটি অনেকটা এরকম –স্ত্রীকে হত্যার দায়ে এক ব্যাংকারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। কিন্তু তিনি নিরপরাধ। কারাগারে যাওয়ার পর তার বাস্তবতাই পাল্টে গেছে। দীর্ঘ সময় বৈরী পরিবেশে থেকে তিনি মুক্তি লাভের সুযোগ খুঁজেন।

দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন

আসলে পুরো সিনেমাটিকেই প্রতীকী বলা যায়। এর ধাপে ধাপে রয়েছে জীবনের নানা দর্শন ও জীবন সম্পর্কে নানা উপলব্ধি। আর সে সঙ্গে ক্যামেরার অসাধারণ কাজ তো আছেই। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও সিনেমাটি মুক্তির পর আশানুরূপ সাফল্য পায়নি।

দুটি বিষয় এখানে প্রভাব ফেলেছিল। প্রথম. সিনেমাটি পাল্প ফিকশন ও ফরেস্ট গাম্পের সঙ্গে হলে মুক্তি পায়। দর্শকদের ওই সিনেমাগুলো নিয়ে আগ্রহ বেশি ছিল। আর দুই. এটির নাম বেশ খটমটে ছিল। ফলে প্রথম শোনায় মানুষ ততোটা আগ্রহী অনুভব করেনি।

তবে মোড় ঘুরিয়ে দেয় অস্কার মনোনয়ন। সাত ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায় দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন। আর ১৯৯৫ সালে এটি চলে আসে ভিএইচএস ক্যাসেটে। অস্কারের মনোনয়নের খবর ততোদিনে ছড়িয়ে পড়ার কারণে মানুষ আগ্রহী হয়ে সিনেমাটি ভাড়া নিতে থাকে, বাকিটা ইতিহাস।

সিনেমাটির আইএমডিবি রেটিং বর্তমানে ৯.৩।

৪. ফাইট ক্লাব (১৯৯৯)

ডেভিড ফিঞ্চারের পরিচালিত দ্য ফাইট ক্লাব সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালে। প্রধান দুই চরিত্রে দেখা যায় এডওয়ার্ড নর্টন ও ব্র্যাড পিটকে। অসাধারণ গল্প, দর্শককে টেনে ধরে রাখার মতো একটি সিনেমা। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও এটি মুখ থুবড়ে পড়েছিল বক্স অফিসে। সিনেমাটি তৈরিতে খরচ হয়েছিল ৬৩ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এটি আমেরিকার ভেতরে আয় করেছিল মাত্র ৩৭ মিলিয়ন ডলার।

বলে রাখা ভালো, সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছিল বিখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক চাক পালানিউকের ফাইট ক্লাব উপন্যাস থেকে। ফলে এটির গল্প যে ভালো হবে, সেটি আগে থেকেই অনুমেয় ছিল। অন্যদিকে ডেভিড ফিঞ্চারের পরিচালনার জাদু নিয়ে তো নতুন কিছু বলার নেই। তাহলে কেন সিনেমাটি সেরকম আয় করতে পারেনি?

ফাইট ক্লাব

সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা এডওয়ার্ড নর্টনের কথা হলো, পরিচালনা, অভিনয় – কোনো কিছুতেই কমতি ছিল না। কমতি ছিল শুধু প্রচারের। সিনেমাটির ড্রিস্টিবিউটর টুয়েন্টিনথ সেঞ্চুরি ফক্স ভালোভাবে কাজ করেনি। এজন্যই এটি ব্যবসা করতে পারেনি।

পরে অবশ্য ফ্লাইট কাব ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে এবং এটি দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছে। মুক্তির দুই দশক পরেও সিনেমাটি দর্শকদের মুগ্ধ করে চলেছে। আইএমডিবিতে এর রেটিং ৮.৮।

৫. চিলড্রেন অফ মেন  (২০০৬)

আলফানসো কুরনের পরিচালিত চিলড্রেন অফ মেনকে ধরা হয় একবিংশ শতাব্দির ভালো সিনেমাগুলোর একটি হিসেবে। এখানে এমন এক ভবিষ্যতের গল্প বলা হয়, যেখানে পুরো দুনিয়া অশান্ত এবং বিশ্বে কোনো শিশুর জন্ম হয় না। মানুষের মধ্যে কোনো আশার আলো নেই।

এই সিনেমাটি তৈরিতে খরচ হয়েছিল ৭৬ মিলিয়ন ডলার। আর গোটা বিশ্ব থেকে সিনেমাটি আয় করেছিল ৬৯ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু পরে এসে হাওয়া পাল্টে যায়। দর্শকদের কাছে এটি সমাদৃত হতে থাকে এবং সিনেমাপ্রেমীদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নেয় এটি।

চিলড্রেন অফ মেন

মজার ব্যাপার হলো, আলফানসো কুরনের নাম সে সময় খুব বেশি মানুষ জানতো না। এ কারণে তার তৈরি সিনেমাটিও তেমন একটি পাত্তা পায়নি। তবে পরে গ্র্যাভিটি সিনেমার মধ্য দিয়ে বিখ্যাত হয়ে উঠে আলফানসো কুরন। আর সে সঙ্গে বিখ্যাত হয়ে উঠে তার এ সিনেমাটিও। রূপালী জগতে যে পরিচিতি প্রায়ই বড়সড় ধরনের প্রভাব ফেলে, এটি তার আরেকটি উদাহরণ।

বর্তমানে আইএমডিবিতে সিনেমাটির রেটিং ৭.৯।

তো এই হলো পাঁচ সিনেমা, যেগুলো শুরুতে ভালো না করতে পারলেও পরবর্তীতে প্রশংসা কুড়িয়েছে ও দর্শকদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। এরকম ঘটনা যে শুধু হলিউডের ব্যাপারে ঘটেছে, তা নয়। বলিউডেও এ ধরনের ঘটনা আছে। পুরো বিশ্বেই আসলে খুঁজলে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যাবে।

আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।