টাইটানিক

টাইটানিককে নিয়ে প্রচলিত তিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

টাইটানিক ডুবেছে ১৯১২ সালে। সে সময় এর চেয়ে বড় জাহাজ এ পৃথিবীতে আর ছিল না। ফলে এটি ডুবে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে অনেকেরই কষ্ট হয়েছিল। এর পেছনে কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল এর প্রচারণাও। কারণ টাইটানিকের যাত্রার আগে বড়াই করে অনেক কথাই বলা হয়েছিল। এমনও দাবি করা হয়েছিল যে এই জাহাজ কোনোভাবেই ডুববে না।

সে-ই জাহাজ যখন সবাইকে হতবাক করে দিয়ে ডুবে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা আলোড়ন তোলে এবং এই একশ বছর পরেও সে আলোড়ন অব্যাহত রয়েছে। সাধারণত এরকম দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যা হয়, এক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে-  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম হয়েছে। অনেকে সেগুলো বিশ্বাসও করেছে। এখনও বহু মানুষ এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলে বেড়ায়।

আর কথা না বাড়াই। চলুন জেনে নেওয়া যাক টাইটানিককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এরকম তিন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা।

১. টাইটানিক আসলে ডুবেনি

হ্যাঁ, একদল মানুষ বিশ্বাস করে যে টাইটানিক আসলে ডুবেনি। আসলে ডুবেছে অন্য একটি জাহাজ। টাইটানিকের নামটি চালিয়ে দেওয়া হয়েছে মাত্র।

এটি টাইটানিককে নিয়ে প্রচলিত ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আস্ত তথ্যচিত্র পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে এ বিষয়ের উপর, লেখা হয়েছে বই – ‘টাইটানিক: দ্য শিপ দ্যাট নেভার স্যাংক?’

book

বইটির লেখক রবিন গার্ডিনারের দাবি, পুরো বিষয়টিই আসলে ইন্সুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে পয়সা হাতানোর জন্য করা হয়েছিল। টাইটানিক নয়, ডুবেছিল অলিম্পিক নামের অন্য একটি জাহাজ।

টাইটানিকের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছিল হোয়াইট স্টার লাইন। আর এই হোয়াইট স্টার লাইন টাইটানিকের আগে ‘অলিম্পিক’ নামে একটি জাহাজ তৈরি করেছিল। যেটি দেখতে একদম টাইটানিকের মতোই। নিজেদের জাহাজগুলোর বীমাও করিয়েছিল হোয়াইট স্টার লাইন।

গার্ডিনারের দাবি, টাইটানিক তৈরি হওয়া ও ডুবে যাওয়ার এক বছর আগে দুর্ঘটনায় পড়ে অলিম্পিক। জাহাজটির সংঘর্ষ হয় এক যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে। যেহেতু বীমা করানো ছিল, সেক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে বীমা কোম্পানির কারণে। বীমা কোম্পানি সাফ জানিয়ে দেয় যে তদন্ত না করে এক পয়সাও দিবে না তারা।

এদিকে অলিম্পিকের খুব একটা যে ক্ষতি হয়েছিল তা না। ঠিকঠাক করে আবার চালানো যাবে এরকম একটা অবস্থা ছিল। ফলে হোয়াইট স্টার লাইন নতুন ফন্দি আঁটে। তারা নতুন জাহাজ তৈরিতে হাত দেয়। নতুন সে জাহাজের জন্য অনেক বড় অংকের বীমা করে। তারপরে নতুন জাহাজটিকে সমুদ্রে না পাঠিয়ে, সে জায়গায় পাঠিয়ে দেয় পুরোনো অলিম্পিককে। নামধাম বদলে দেওয়া হয়। আর দেখতেও অনেকটা একই রকম থাকার কারণে কেউ বিষয়টি টের পায়নি।

গার্ডিনার আরও দাবি করেছেন, হোয়াইট স্টার লাইন আসলে এতো মানুষ মারতে চায়নি। তাদের পরিকল্পনা ছিল একটা নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে অলিম্পিক ডুবে যাবে। সেখানে আগে থেকেই আরেকটি জাহাজ থাকবে, যেটি সব যাত্রীকে উদ্ধার করতে পারবে। কিন্তু নির্ধারিত স্থানে যাওয়ার আগেই অলিম্পিক ডুবে যায়। ফলে ব্যাপক প্রাণহানি হয়।

কিন্তু গার্ডিনারের এ দাবিতে অনেক বড় শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। ১৭ থেকে ১৯ শতকে জাহাজ তৈরি হতো কাঠ দিয়ে। আর প্রতিটি জাহাজের জন্য একটি নির্মাণ নাম্বার থাকতো। নিয়মানুসারে, জাহাজে ব্যবহৃত প্রতিটি কাঠে ওই নির্মাণ নাম্বার খোদাই করে দেওয়া হতো। টাইটানিকের নির্মাণ নাম্বার ছিল ৪০১। আর অলিম্পিকের নির্মাণ নাম্বার ছিল ৪০০।

টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ থেকে যেটুকু ভেসে উঠেছিল, সেগুলোতে ৪০১ নাম্বারটি খোদাই করা ছিল। অন্যদিকে অলিম্পিককে পরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেটির সব কাঠ খুলে ফেলা হয়। ওই কাঠের কোনোটিতে ৪০১ নাম্বার দেখা যায়নি। সব নাম্বার ছিল ৪০০ – অলিম্পিকের আসল নির্মাণ নাম্বার। মানে টাইটানিকই ডুবেছে, অলিম্পিক নয়।

২. টাইটানিক ডুবিয়ে দিয়েছিলেন জেপি মর্গানjp morgan photo

এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বটিও বেশ প্রচলিত। টাইটানিক নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই এটি সামনে চলে আসে। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে দাবি করা হয়, সে সময়ের ধনকুবের জেপি মর্গান যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক তৈরি করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তাকে বাঁধা দিচ্ছিলেন আরও তিন জন ধনী ব্যক্তি – জন জ্যাকব অ্যাস্টর, বেঞ্জামিন গুগেনহাইম ও ইসিডোর স্ট্রাউস।

তো এই প্রতিবন্ধকতা হটাতে জেপি মর্গান ওই তিন ব্যক্তিকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুসারে, বিলাসবহুল জাহাজ তৈরি করেন নিজের প্রতিষ্ঠান হোয়াইট স্টার লাইন থেকে। তারপর সেটিতে তিন জনকে আমন্ত্রণ করেন। ভান করেন যে তিনিও জাহাজে চড়বেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আর তিনি চড়েন না। ব্যস এভাবেই দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেন ওই তিন জনকে। কাহিনীটা সিনেমার মতো শোনালে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আসলেও এটি বেশ রঙচঙা একটি গল্প।

সব ষড়যন্ত্র তত্ত্বই কোনো না কোনো আংশিক সত্যকে আঁকড়ে ধরে গড়ে উঠে। এটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আসলেও ওই তিন ব্যক্তি টাইটানিকে ছিলেন এবং সলিল সমাধি হয়েছিল তাদের। আর জেপি মর্গানেরও শেষ মুহূর্তে ব্যক্তিগত কারণে আর জাহাজে উঠা হয়নি। কিন্তু তা-ই বলে প্রতিদ্বন্দ্বী সরাতে এতো মানুষের প্রাণ নেওয়ার এবং নিজের এতো বড় আর্থিক ক্ষতি করার কথা শুধু কোনো উন্মাদ ব্যক্তিই ভাবতে পারেন। জেপি মর্গান আর যা-ই হোক না কেন, উন্মাদ ছিলেন না। তিনি যদি প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরাতে চাইতেন, তাহলে সহজভাবেই তা করতে পারতেন। এতটুকু ক্ষমতা তার ছিল। জাহাজ তৈরি করে এতো ঘটা করে এসব করার দরকার ছিল না!

এর চেয়েও বড় কথা হলো – এরকম কোনো পরিকল্পনা করলে, তা জেপি মর্গানের একার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। অনেক মানুষের সহায়তা দরকার হতো তার। যদি সত্যিই তিনি এটি করতেন, তাহলে কেউ না কেউ এতোদিনে সব গোপন কথা ফাঁস করেই দিতো। বিশেষ করে টাইটানিক নিয়ে যে মাত্রায় তোলপাড় হয়েছে, তাতে এটি চাপা থাকার প্রশ্নই আসে না।

৩. টাইটানিককে জার্মান ইউ-বোট ডুবিয়ে দিয়েছে 

টাইটানিক যখন ডুবে যায়, সে সময় পুরো বিশ্বেই ছিল শান্তি। বড় কোনো যুদ্ধ চলছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এ ঘটনার দুই বছর পরে। কিন্তু তারপরও প্রায়ই শোনা যায় – টাইটানিককে আসলে জার্মান ইউ-বোট হামলা করে ডুবিয়ে দিয়েছে।

যদিও এটির পক্ষে পোক্ত কোনো প্রমাণ নেই। পরবর্তীতে যে বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে, তাতে জার্মানির পরাজয় হয়েছিল। ফলে তারা এটি করে থাকলে, এতোদিনে কোনো না কোনো প্রমাণ সামনে চলে আসতো।

তাহলে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কীভাবে ছড়ালো? কেন-ই বা এতো বড় একটা দাবি করা হলো? এর উত্তরটা আসলে লুকিয়ে আছে টাইটানিক যাত্রীদের বয়ানে। ওই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরাদের অনেকেই জানিয়েছেন যে ডুবে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনেছেন তারা। অনেকে আবার দাবি করেছেন, টাইটানিকের খুব কাছেই ডুবোজাহাজের মতো কিছু একটা দেখেছেন তারা।

এখানে বলে রাখা ভালো- টাইটানিক যখন ডুবছিল, তখন ছিল রাত। ওই অন্ধকার ভেদ করে ডুবোজাহাজ কারও চোখে দেখতে পাওয়ার কথা না। ফলে এই দাবিটিকেও সত্যি বলে ধরে নেওয়া যাচ্ছে না।

যা-ই হোক, এই হলো টাইটানিককে নিয়ে প্রচলিত তিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, যা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আলোচনা করে আসছে মানুষ। এখনও বিভিন্ন স্থানে মানুষকে এগুলো নিয়ে তর্কে জড়াতে দেখা যায়।

আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।