হিরানীর ডানকি

হিরানীর ডানকি যেখানে ব্যর্থ ও যেভাবে সফল

‘রাশিয়া থেকে যখন শীতকালে পাখি উপমহাদেশে বাচার আশায় আসে, উপমহাদেশের পাখিরা তাদের তাড়িয়ে দেয়না, আক্রমণ করেনা। কারণ তারাও বোঝে ওরা বাঁচার জন্য যাবে কোথায়, ওদের দেশ তো বরফে ছেয়ে গেছে।’

রাজকুমার হিরাণীর সিনেমার একটা গতানুগতিক কাঠামো আছে। সে কাঠামোতে দেখা যায় – চরিত্র অবাস্তব এক ফ্যান্টাসির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং সে যে পরিস্থিতিগুলোর সম্মুখীন হচ্ছে, সেগুলো নানা ধরনের সামাজিক বার্তা দিচ্ছে।

এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে – কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফ থ্রি ইডিয়টসের মতো মটোতে চলে না। মুন্না ভাইয়ের মত ভাইরা মেডিকেলে জায়গা পায়না। পিকে’র মতো কোনো এলিয়েন এখনও বিশ্বের বুকে আসেনি।

অথচ উপরের ওই তিন সিনেমাতেই প্রোটাগনিস্টকে সামনে রেখে সামাজিক বার্তা দিয়ে গেছেন হিরানী। তবে ডানকি এখানে আলাদা।

ডানকি কোথায় আলাদা জানেন?  এ সিনেমাতেই প্রথমবারের মতো হিরানি নিজের চরিত্রকে ফ্যান্টাসি জোন থেকে বের করে এনে এমন এক বাস্তবতায় ফেলেছেন, যার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ন বিশ্বের অগণিত মানুষ যাচ্ছেন। তিনি ওই মর্মান্তিক বাস্তবতা দিয়েই ড্রামা তৈরি করতে চেয়েছেন। আর এই জায়গাটা অনেকেরই ভালো লাগেনি। বিশেষ করে হিরানীর গতানুগতিক ভক্তদের। তারা যা চেয়েছিলেন, তা তারা পাননি। সামাজিক বার্তা পেলেও তাদেরকে হিরানী বঞ্চিত করেছেন ফ্যান্টাসি কাঠামো থেকে।

ডানকিতে যে সমস্যা দেখানো হয়েছে, তা ২৫ বছর আগেও ছিলো। আজও আছে। এ এক অদ্ভুত সমস্যা!

এ সিনেমায় সমস্যা নিয়ে আলাপ হয়েছে বিস্তর। কিন্তু সমাধান কেউ দেয়নি। আপনি একটু খেয়াল করে দেখুন –মুন্নাভাই এমবিবিএস, থ্রি ইডিয়টস, পিকে – এগুলোতে পোক্ত সমাধান আছে, সুন্দর সমাপ্তি আছে। কিন্তু ডানকি শেষ হয়েছে দর্শকদের ভেতরে অপূর্ণতা রেখে। সিনেমার চরিত্ররা যেমন তাদের লক্ষ্য পেয়েও কিছুই পাননি, দর্শকরাও ঠিক তাই। তারা হিরাণীর সিনেমা পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু চিরচেনা সেই সমাপ্তি পাননি।

অনেকে বলতে পারেন ডানকি সিনেমার রিভিউয়ে কেন হিরানীর অতীতের কথা টানছেন? টানার কারণ আছে। সিনেমার মুক্তির পর বাজারে যখন এটিকে মানুষ তুলনা করেছে, তখন তারা করেছে আগের কাজের সঙ্গে। ফলে এখানের আলোচনাও ওই একই খাতে যাওয়া উচিত।

ডানকি সিনেমার চিত্রনাট্যে কমতি ছিল। সেটা আরও গোছগাছ করে করা যেত। তাছাড়া স্টোরিলাইনে এতো টুইস্ট-টার্ন না রেখে উপস্থাপন করা যেতো। গল্পের গতি হয়ে গিয়েছিল অতি দ্রুত। দর্শক ঠিকভাবে সংযোগ স্থাপন করার আগেই চলে এসেছিল ক্লাইম্যাক্স। একত্রে অনেক চরিত্রের বিশদ বিস্তারিত তুলে ধরার কারণেও এমনটা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছি।

কিন্তু বাকি সব? পরিচালনা, অভিনয়, আবহ সঙ্গীত, চিত্রগ্রহণ, সংলাপ? সেগুলোতে কী কমতি আছে? এক কথায় বলতে হয়, না… নেই।

হিরানী তার গতানুগতিক ফর্মুলার বাইরে যেয়ে নিখাঁদ ড্রামা তৈরির চেষ্টা করেছেন। এ কাজ উনি নয়, বলিউডের আরও অনেক পরিচালক বহুবার করার চেষ্টা করেছেন। সিনেমাটিকে শাহরুখ খানের ‘সো কল্ড’ বক্স অফিস সাফল্যের চশমায় বিচার করলে – এটি ভালো করেনি। তবে শাহরুখ টানা যে তিন সিনেমা উপহার দিয়েছেন – পাঠান, জাওয়ান ও ডানকি – তার মধ্যে দিনশেষে ডানকি টিকে থাকবে বলে আমার ধারণা।

কারণ পাঠান ও জাওয়ান আপনাকে ধরে রাখে, সাময়িক সময়ে আনন্দিত রাখে। অন্যদিকে ডানকি আপনাকে দেখায় সমাজে বিদ্যমান এক বাস্তবতার গল্প, যা দূর ভবিষ্যতেও থাকবে। আপনি আজ থেকে ১০ বছর পরেও খবরের কাগজের পাতা খুলে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণ হারানো মানুষের খবর পাবেন।

ভারতীয় দর্শকরা বরাবরই নিজেদের সিনেমার বিষয়ে বেশ অন্যরকম। আশুতোষ গোয়ারিকারের লাগান সিনেমার কথাই ধরুন। সারা দুনিয়ার দর্শকের কাছেই সিনেমাটির আলাদা দাম আছে। আসলেই আশুতোষ গোয়ারিকারের এই সিনেমা বলিউডের অন্যতম মাইলস্টোন। আর অস্কারের ফাইনাল সাবমিশন পর্যন্ত যাওয়ার কারণে এটিতে আলাদা ভ্যালুও যোগ হয়েছে।

এখন আসুন ভারতীয় দর্শকদের দিকে। তারা আশুতোষ গোয়ারিকারের লাগানকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করলেও, তারই নির্মিত স্বদেশকে সেভাবে নেয়নি। বক্স অফিসে ফ্লপ করেছিল স্বদেশ।

এর কারণ হলো – লাগানে কোনোদিন ক্রিকেট না খেলা স্থানীয় গ্রামবাসীদেরকে প্রশিক্ষিত ইংরেজদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে দেখে যে টানটান উত্তেজনা পাওয়া যায়, তা স্বদেশে নেই। বিদেশের কাউকে হারিয়ে দেশকে জেতানোর মতো কিছু নেই। বরং একজনের নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গল্প আছে। দেশের রূঢ় বাস্তবতা আছে।

ফলে লাগান থেকে অনেক ভালো সিনেমা হওয়া স্বত্ত্বেও স্বদেশ দীর্ঘ একটা সময় নিজ দেশেই পেছনে পড়ে ছিল। কিন্তু দুনিয়াজুড়ে তা নাম কামিয়েছে ঠিকই।খ্যাতনামা ভারতীয় চলচ্চিত্র সমালোচক তারান আদার্শ পর্যন্ত ওই সিনেমাকে দেড় স্টার দিয়েছিলেন!

একই ঘটনা দেখা যায় মাই নেম ইজ খানের ক্ষেত্রেও। ৯/১১ এর পর যেখানে গণহারে মুসলিমদের আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে সন্ত্রাসীর তকমা দেওয়া হচ্ছে এবং একটা পর্যায়ে তা বাড়তে বাড়তে অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেলো। সে সময় শাহরুখ ও কারান জোহার মিলে বানালেন মাই নেম ইজ খান। তুলে ধরলেন – সব মুসলিমই সন্ত্রাসী নন। এক অর্থে পুরো ‍দুনিয়ার প্রবাসী মুসলিমদের পাশে দাঁড়ালেন।

কিন্তু ভারতীয় দর্শক বা সমালোচক কিন্তু সিনেমাটির প্রতি সে সময় সুবিচার করেননি। কী ঘটেছিল, তা একটু ঘাঁটলেই পেয়ে যাবেন।

ডানকির ক্ষেত্রেও অনেকাংশে তাই ঘটেছে। হিরানী যদি তার সেই ফ্যান্টাসি মোডে গিয়ে এমন কোনো সুপারহিরো আমদানি করতো যে কি না বিদেশে যেতে আগ্রহী সব মানুষকে দেশ থাকার বিষয়ে রাজি করিয়ে ফেলতো – তাহলে মানুষের হয়তো খুব পছন্দ হতো।

কিন্তু হিরানী সেটা করেননি। যারা পেটের দায়ে বিদেশে যায়, পরিবার আর নিজের সম্মানের রুটি রুজির জন্য এত ঝুঁকি নিয়ে প্রবাসে যায়, তাদের দুনিয়া ঠিক করবার মেন্টালিটি থাকে না। তাদের চোখে থাকে নিজের কাছের মানুষ আর পরিবার ঠিক করার চিন্তা।

মূলত ডানকির ক্ষেত্রে এটাই ছিলো হিরানীর সবচেয়ে বড় ভুল। তার দ্বিতীয় ভুল ছিল- সিনেমার প্রোটাগনিস্টকে ওল্ড স্কুল রোমান্টিক হিরোর মত বানানো। বর্তমানে আলফা মেলের জয়জয়কার। সেটা তো এখানে নেই!

আর তৃতীয় ভুল হলো ডানকিতে কোনো ভিলেন নেই। হিরানী আর একটি কাজ করেননি। সেটা হলো, তিনি অল ইজ ওয়েল, জাদু কি ঝাপ্পি ঘরানার কোনো হুক লাইন সংলাপ রাখেননি।

বক্স অফিসে এটা ইন্ডাস্ট্রি হিট না হোক, আমার ধারণা ১২ বছর পর লোক পাঠান, জওয়ান থেকেও এই সিনেমার কথা বেশি বলবে।

উইজ বাল্বের জন্য লেখাটি লিখেছেন: রাজা জহুর খান

আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।