জনসন বেবি পাওডারের

জনসন বেবি পাওডারের ‘ভয়ঙ্কর’ কেলেঙ্কারি

জনসন বেবি পাওডারের নাম শুনেননি এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। সত্যি বলতে, জনসন অ্যান্ড জনসন নামে যে একটা কোম্পানি আছে, সেটাই আমরা অনেকে জেনেছি ওই বেবি পাওডার থেকে। এ অবস্থা শুধু বাংলাদেশের না, দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের।

এই জনসন অ্যান্ড জনসন বিরাট প্রতিষ্ঠান। এটার অধীনে ফার্মাসিটিউক্যাল কোম্পানি আছে, মেডিকেলের বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরি করে এমন প্রতিষ্ঠানও আছে। তবে এরা সবচেয়ে বিখ্যাত নিজেদের বেবি প্রোডাক্টের জন্য।

বেবি শ্যাম্পু, বেবি অয়েল, লোশন, পাওডার – আরও বহু কিছু বাজারজাত করে এরা। এবং দিনের পর দিন এটা করতে করতে পুরো বিশ্বে মানুষের মধ্যে আস্থার একটা জায়গা তৈরি করে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটা।

অবস্থাটা অনেকটা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, মানুষ অনেকটা চোখ বন্ধ করেই তাদের প্রোডাক্ট কিনে। বাসায় বাচ্চা আছে, এবং সে বাসায় কখনও জনসনের কোনো প্রোডাক্ট কেনা হয়নি – এরকম বাসার সংখ্যা বেশ কম।

জনসন অ্যান্ড জনসনের জন্য এই বেবি প্রোডাক্ট অনেক বড় একটা ব্যবসা। ২০২২ সালে পুরো বিশ্বে এই প্রতিষ্ঠানটা এ ধরনের পণ্য বিক্রি করেছে ১৪৬ কোটি ডলারের। অনেক বড় অঙ্ক।

তবে অনেকেই হয়তো জানেন না যে সবচেয়ে বড় অন্যায়টাও এই বেবি প্রোডাক্টের ক্ষেত্রেই করেছে জনসন অ্যান্ড জনসন। জেনেশুনে তারা যা করেছে, সেটা আসলে অন্যায় ও অপরাধের পর্যায়েই পড়ে।

এ কাহিনীটা ভালো করে জানতে হলে আমাদের যেতে একটু পেছনে। ৯০-এর দশকের শেষের দিকে।

ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের বাসিন্দা ডারলিন কোকারের শরীরে ধরা পড়ে ক্যান্সার। আর এই ক্যান্সারের টাইপটা একটু অদ্ভুত ধরনের, বেশ বিরল, কিন্তু প্রাণঘাতি। এটার নাম মেজোথেলিওমা। এই ক্যান্সারটা হয় যদি আপনি অ্যাসবেসটস নামের একটা উপাদানের সংস্পর্শে আসেন, তাহলে।

সাধারণত খনি শ্রমিক ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের মধ্যে এটা বেশি দেখা যায়। কিন্তু ডারলিনের ক্ষেত্রে তা হওয়ার কোনো উপায়ই নেই। কারণে একে তো সে ওরকম কিছুর সঙ্গে জড়িত না। আর দ্বিতীয়ত তার অ্যাসবেসটোসের কাছাকাছি আসার মতো কোনো সুযোগ নেই।

কী করবে তা বুঝতে না পেরে, হার্শেল হবসন নামের এক আইনজীবীকে নিয়োগ দিলেন ডারলিন। তাকে বলা হল যে মেইনলি কী হয়েছে তা খুঁজে বের করতে এবং সেটার ভিত্তিতে আইনি ব্যবস্থা নিতে।

আপনার কাছে শুনে অদ্ভুত মনে হতে পারে বিষয়টা। কিন্তু বিশ্বে এরকম স্পেশালাইজড আইনজীবী আছেন। তাদেরকে বলা হয় পার্সোনাল ইনজুরি ল’ ইয়ার। তারাই এ কাজটা করেন এবং এ ধরনের আইনজীবীরা ঘটনার মূল পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ দক্ষ।

তো হার্শেল হবসন একটু ঘাঁটাঘাাঁটি করে জানাল, এটা জনসন অ্যান্ড জনসনের বেবি পাওডার থেকে হয়ে থাকতে পারে। ডারলিন ওই পাউডারটা তার মেয়ের জন্য ব্যবহার করেছেন। পরে নিজের কাছেও প্রোডাক্টটা ভালো লেগে যায়। তাই তিনিও সেটা ব্যবহার করেছেন।

হবসনের এই সন্দেহের পেছনে মূল কারণ ছিল- ওই পাওডারে থাকা অন্যতম এক উপাদান ‘ট্যালক’। এই উপাদানটা খনি থেকে উত্তোলন করতে হয় এবং বলা হয় এটা পৃথিবীর সবচেয়ে নরম খনিজ।

মাটির নিচে ট্যালকের খু্ব কাছেই থাকে অ্যাসবেসটস। ফলে প্রাকৃতিকভাবে অনেক সময় ট্যালক দূষিত হয়ে যেতে পারে। যদি খনিজ উত্তোলনের সময় এটার ব্যাপারে খেয়াল না রাখা হয়, তাহলে ওই দূষিত ট্যালক চলে আসতে পারে বাইরে।

দুইয়ে দুই চার মিলিয়ে হবসন ধারণা করেন, এই পাওডারের ট্যালকে কোনো ঝামেলা আছে। তিনি সেভাবেই ব্যবস্থা নেন। ১৯৯৭ সালে ডারলিন ও তার স্বামী মামলা করেন জনসন অ্যান্ড জনসনের বিরুদ্ধে।

কিন্তু আলটিমেটলি তারা সেটা আদালতে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন। জনসন অ্যান্ড জনসন দাবি করে, তাদের ট্যালকে কোনো ঝামেলা নেই। সেটা সম্পূর্ণ ঠিক আছে। এবং তারা সেটা পরীক্ষা করেও দেখেছে। আদালতও শক্ত প্রমাণ না থাকার কারণে আলাদা করে জনসন অ্যান্ড জনসনের পাওডার পরীক্ষা না করেই ছেড়ে দেয়।

ডারলিনের আইনজীবী হবসন বারবার অনুরোধ জানান যে আদালত যাতে জনসন অ্যান্ড জনসনের অভ্যন্তরীন পরীক্ষার নথিপত্র পরীক্ষা করে। সেসব পরীক্ষায় তারা কী দেখেছে বা পেয়েছে, সেগুলো খতিয়ে দেখে। হবসন সেসব নথি আদালত যাতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় এমন অনুরোধও করেন।

কিন্তু আদালত সেটা করে না। রেহাই পেয়ে যায় জনসন। ১৯৯৯ সালে মামলা থেকে সরে আসতে বাধ্য হন ডারলিন। অথচ ওই সময়ে প্রতিষ্ঠানটিকে আটকানো সম্ভব হলে হাজার হাজার জীবন বাঁচানো সম্ভব হতো।

এরপর আরও প্রায় ২০ বছর ওই পাওডার বিক্রি করতে থাকে প্রতিষ্ঠানটা। ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীও বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে এসে দেখা যায়, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১১ হাজার সাতশ জন মামলা করে বসেছেন জনসন অ্যান্ড জনসনের বিরুদ্ধে।

জনসনের তো সেই আগের কথা – আমার প্রোডাক্ট ভালো। এটা আমরা অভ্যন্তরীনভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। ক্ষতিকর কিছু নেই।

কিন্তু এবার যারা মামলা করেছেন তাদের হাতে কিছু প্রমাণ ছিল। আদালতও এই দফা নানা ধরনের কাগজ পত্র চেয়ে বসে। সেগুলো জমা দিতে হয় জনসনকে। এসব কাগজ পত্রের মধ্যে অভ্যন্তরীন প্রতিবেদন, কোম্পানি মেমো, আইনজীবীদের সঙ্গে কথাবার্তার গোপন নথি – অনেক কিছু ছিল।

সেসবের ভিত্তিতে আদালতে প্রমাণ হয়ে যায় জনসনের ট্যালকম পাওডারে অ্যাসবেসটোস আছে। এবার ব্যাপক জরিমানার কবলে পড়ে জনসন অ্যান্ড জনসন। শুরুতেই কয়েকশ কোটি ডলারের জরিমানা করা হয় প্রতিষ্ঠানটাকে। টাকার অঙ্কে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ দিতে বলা হয় ২২ জন নারীকে। এ ছাড়া আরও তো হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষায় আছেই।

এদিকে, আদালতে জমা পড়া কাগজপত্র থেকে অনেক কুকীর্তি বের হয়ে আসতে শুরু করে। জানা যায়, ১৯৭১ থেকে ২০১০ পর্যন্ত অনেকবার জনসন অ্যান্ড জনসন নিজেদের ‘ট্যালক’ এবং সেটা থেকে তৈরি পাওডারে অ্যাসবেসটসের উপস্থিতি পেয়েছে।

সেসবের ব্যাপারে জনসন অ্যান্ড জনসনের উপরমহল অবগত ছিল। এগুলো জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটিরই নির্বাহী, খনির ম্যানেজার, ডাক্তার, আইনজীবী, গবেষক- এরা। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে সেসব খবর কখনো বাইরে আসেনি। সব সময় গোপন ছিল।

শুধু তাই না, কসমেটিক ট্যালক প্রোডাক্টে কতোটুকু মাত্রার অ্যাসবেসটস থাকতে পারবে, তাতে খুব কড়া নজর রাখে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকরা। এটার মাত্রা হয় খুব অল্প পরিমাণ। যেটাতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই, শুধু সেটুকু থাকলেই অনুমোদন দেওয়া হয়।

নিয়ন্ত্রকরা যাতে ওই মাত্রার চেয়ে একটু বেশি অ্যাসবেসটস থাকলেও প্রোডাক্ট নিয়ে কোনো আপত্তি না করে, সেটার জন্যও চেষ্টা করেছিল জনসন। সফলভাবে ক্ষমতাসীন অনেককে প্রভাবিত করে নিজেদের কাজ আদায় করে নিয়েছিল তারা।

যা-ই হোক, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অনলাইন থেকে জনসনের বেবি পাওডার কিনে তারপর সেটা পরীক্ষা করে। দেখে যে ওটার মধ্যে বিপজ্জনক মাত্রায় অ্যাসবেসটোস আছে।

পরে জনসন অ্যান্ড জনসন ৩৩ হাজার বোতল বেবি পাওডার বাজার থেকে সরিয়ে নেয়। একবার চিন্তা করেন এটা শুধু একটা দেশের কাহিনী। জনসন অ্যান্ড জনসন পুরো বিশ্বে পাওডারটা বিক্রি করে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশ ততদিনে অবশ্য কিছুটা নড়েচড়ে বসে। যেমন, ভারত জনসন অ্যান্ড জনসনের বেবি পাওডার পরীক্ষা করে, কড়া পদক্ষেপ নেয়। আবার কানাডাও কড়া স্টেপ নেয়।

সম্ভবত এসব কারণেই ২০২০ সালে জনসন জানায়, তারা আর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় নিজেদের বেবি পাওডারে ট্যালক ব্যবহার করবে না। অন্য উপাদান দিয়ে তৈরি করবে। তবে গ্লোবাল মার্কেটের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশে তারা ট্যালক দিয়ে তৈরি পাওডারই বিক্রি করবে।

এটা নিয়ে ব্যাপক ঝামেলা হয়। কিন্তু তারপরও প্রায় দুই বছর এভাবে চলে। পরে ২০২২ সালের অগাস্টে তারা জানায়, একেবারে ট্যালক দিয়ে পাওডার তৈরিই বন্ধ করে দিচ্ছে তারা। পুরো বিশ্বেই এটা বন্ধ হয়ে যাবে ২০২৩ সাল থেকে।

যে সময় এ ঘোষণা দেওয়া হয় সে সময় ৩৮ হাজার মামলা চলছিল প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীরাই মামলাগুলো করেছিল। কেউ হয়তো ক্যান্সারে ভুগছে কেউ বা আবার মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছে – সবাই ক্ষতিপূরণ চাচ্ছিল। আসলে তো এটা তাদের প্রাপ্য।

ঘটনা এখানে শেষ হয়ে গেলেও পারত। যে সবাই সবার ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। আর জনসন ক্ষতিকর ওই পাওডার তৈরি বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু তা হয়নি।

এই যে বিপুল জরিমানা হয়েছে জনসন অ্যান্ড জনসনের নামে এটা তারা ঠিকভাবে দিতে চায় না। এ ছাড়াও আরও যে জরিমানা হতে পারে সেটা থেকেও গা বাঁচাতে চায় তারা। আর এই কাজ দুটা করতে অভিনব একটা পথ বের করেছে তারা।

২০২১ সালের অক্টোবরে, মানে পুরো বিশ্বে ট্যালক পাউডার বিক্রি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার এক বছর আগে জনসন অ্যান্ড জনসন নিজেদেরই একটা সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান খুলে, সেটার নাম দেয় এলটিএল ম্যানেজমেন্ট।

তারপর ট্যালক সংক্রান্ত যত দাবি দাওয়া ছিল, সব দাবিকে সেটার অধীনে দিয়ে দেয়। এরপর তারা বলে যে ওই প্রতিষ্ঠান এটা হ্যান্ডেল করবে। কারণ ট্যালক পাউডারের মালিকানা তো ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে। এরপর তারাই আবার সেই এলটিএল ম্যানেজমেন্টকে দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্য আদালতে গিয়ে আবেদন করে।

এখানেও শেষ নয়। এর পরে জনসন অ্যান্ড জনসন আদালতে প্রস্তাব দেয় – যেহেতু তাদের ওই প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেছে, সেহেতু ক্যানসার সংক্রান্ত যেসব মামলা চলছে, সেগুলোর সমঝোতার জন্য তারা সাকুল্যে ৮৯০ কোটি ডলার দিবে। এই অর্থের মধ্যেই সব মামলার সমঝোতা করতে হবে এবং এই সংক্রান্ত নতুন আর কোনো মামলা কেউ কখনও দায়ের করতে পারবে না।

অথচ একদম শুরুতে শুধু ২২ জনকেই কয়েকশ কোটি ডলার দিতে বলেছিল আদালত।

স্বাভাবিকভাবেই আদালত তাদের সে দাবি মানেনি এবং বিচারক এলটিএল ম্যানেজমেন্টকে দেউলিয়া ঘোষণা করেনি। কিন্তু জনসন নাছোড়বান্দা। প্রতিষ্ঠানটা দ্বিতীয়বারের মতো আবেদন করে। এবারও আদালত সে আবেদন খারিজ করে দেয়। জনসন এবার তৃতীয়বারের মতো আবেদন করে।

এটা আসলে একটা কৌশল। আদালত যতবার মানা করছে, ততবার তারা আবেদন করছে। আর এদিকে যতগুলো মামলা আটকে ছিল, সব ঝুলে গেছে। যাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা ছিল, সেগুলোও আটকে গেছে।

এই পরিস্থিতি ২০২৪ সালেও চলেছে। কবে শেষ হবে তা বলা সম্ভব না।

বলে রাখা ভালো, জনসন অ্যান্ড জনসন ট্যালকম বেবি পাওডার বিক্রি করেছে একশ বছরেরও বেশি সময়। কত মানুষ যে চোখ বন্ধ করে তাদের পণ্য কিনেছে, নির্ভর করেছে। অনেকে হয়তো মরেও গেছে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে, জানতেও পারেনি কীসের জন্য কী হয়েছে।

তো এই হলো জনসন অ্যান্ড জনসনের বেবি পাওডার কেলেঙ্কারি।

আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।