পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল গ্রাম

ওইমিয়াকন: পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল গ্রাম

আচ্ছা, পৃথিবীর এমন একটা ঠাণ্ডা জায়গার নাম বলেন তো যেখানে প্রচুর ঠাণ্ডা পড়ে, কিন্তু মানুষ থাকে? আপনি হয়তো রাশিয়ার সাইবেরিয়ার ইয়াকুটস্ক শহরের নাম বলবেন।

কিন্তু ইয়াকুটস্ক থেকেও বেশি ঠাণ্ডা একটা জায়গা আছে, যেখানে মানুষ থাকে। এটাকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে ঠাণ্ডা গ্রাম। ওই গ্রামের নাম ওইমিয়াকন।

এ গ্রামটিও রাশিয়ার সাইবেরিয়াতেই। ইয়াকুটস্ক থেকে একটু দূরে। বলা ভালো, আরও ভেতরে।

শীতের সময় এ জায়গাটায় গড় তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তীব্র ঠাণ্ডায় পথঘাট সব জমে যায়। এ সময় মানুষের চলাচল থেকে শুরু করে একদম সাধারণ কাজকর্মগুলোও খুব কঠিন হয়ে যায়।

ঘরের ভেতরের পানির পাইপ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। কারণ সেগুলো সব জমে যায়। এতে করে রান্নাঘর, টয়লেট সব অকেজো হয়ে পড়ে।

এমনকি শীতকালে এখানে কেউ যদি মারা যায়, তাহলে এতো ঠাণ্ডায় কবর খোঁড়াও কঠিন হয়ে যায়। এরকম সিচুয়েশনে প্রথমে মাটির ওপর আগুন জ্বালিয়ে নিয়ে ওই মাটির তাপমাত্রা একটু স্বাভাবিক করে নেওয়া হয়। তারপর ওই জায়গায় কবর খুঁড়ে বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়। অনেক সময় এভাবে কাউকে কবর দিতে তিন দিন লেগে যায়।

ওইমিয়াকনের বাসিন্দাদের যাদের গাড়ি আছে, তারা বেশির ভাগই শীতকালে নিজেদের গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে না। সেগুলো টানা চলতে থাকে। কারণ একবার যদি গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেটাকে আর চালু করা সম্ভব হবে না।

শীতের সময় যাতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে, সেজন্য ওইমিয়াকনের আকাশসীমার ওপর দিয়ে বিমান উড়ানো বন্ধ থাকে। এক অর্থে জায়গাটি একরকম অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

একটা ব্যাপার বলে রাখা ভালো, শীতকালে এই যে মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, এটা কিন্তু আসলে গড় তাপমাত্রা। কোনো কোনো দিন ঠাণ্ডা এর চেয়েও বেশি পড়ে। এমনিতে তাপমাত্রা যদি মাইনাস ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকে, তাহলেই ওইমিয়াকনের বাসিন্দারা খুশি হয়ে যায় যে যাক আজকের দিনটা একটু গরম!

শীতের সময় দিনের আলো খুব অল্পই পান এখানের মানুষরা। মাত্র তিন থেকে চার ঘণ্টার মতো আলোকিত থাকে জায়গাটা। আর প্রায় ২০-২১ ঘণ্টা থাকে রাতের অন্ধকার।

এই তীব্র ঠাণ্ডার মধ্যেও ওইমিয়াকনে পাঁচশর মতো মানুষ থাকেন। একসময়ে এই জনসংখ্যা আরও বেশি ছিল। প্রায় আড়াই হাজার মানুষ থাকত এখানে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কমতে শুরু করে। সর্বশেষ ২০১৮ সালেও ওইমিয়াকনে ৯০০’র মতো মানুষ ছিল। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচশতে।

ওইমিয়াকনে রাতের তাপমাত্রা। ছবিটি রেডিট থেকে সংগৃহীত।

আপনি যদি ওইমিয়াকনে যান, তাহলে গ্রামটার মাঝখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে পাবেন। কংক্রিট দিয়ে তৈরি বড় আকারের একটা ষাঁড়। সেখানে আবার একটি তাপমাত্রা খোদাই করে লেখা। ১৯২৪ সালে ওইমিয়াকনে একবার তাপমাত্রা মাইনাস ৭১ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, এর চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা ওইমিয়াকন আর কখনও দেখেনি। ওই ঘটনার স্মরণেই এই স্মৃতিস্তম্ভ।

ওইমিয়াকনের এই তীব্র ঠাণ্ডার জন্য এ অঞ্চলটিতে কোনো ধরনের ফসল হয় না। এজন্য এখানে যারা থাকেন, তারা ‍সুপ, ঠাণ্ডা মাছ, মাংস – এসব খাবার খেয়ে থাকেন। এবং তারা ঠাণ্ডা মাছ, মাংস খুব পছন্দও করেন।

ব্যাপারটা আপনার-আমার কাছে শুনতে অন্যরকম মনে হতেই পারে। আমরা গরম খাবার দেখে অভ্যস্ত। গরম খাবার খেয়ে অভ্যস্ত। কিন্তু ওইমিয়াকনের জন্য ঠাণ্ডাটাই বাস্তবতা। ফলে ওখানকার মানুষ বেশ মজা করেই ঠাণ্ডা খাবারটা খায়।

ভালো কথা, ওইমিয়াকন নামটির কিন্তু খুব সুন্দর একটা অর্থ আছে। এটার অর্থ হলো- সেই পানি যা কখনও জমে না। নামটা একটু অবাক করার মতো, কারণ এখানে এতো ঠাণ্ডা যে সব জমে যায়। তাহলে এই নাম কীভাবে এলো?

আসলে ব্যাপারটা হল, এই জায়গার খুব কাছেই একটা ঝরনা আছে। সেখানে প্রাকৃতিকভাবেই উষ্ণ পানি পাওয়া যায়। বহু আগে মানুষ ওই ঝরনায় নিজেদের বলগা হরিনের পালের জন্য পানি নিতে আসত। সেখানে থেকেই এই ওইমিয়াকন নামের উৎপত্তি।

এমনিতে এই জায়গাটায় মানুষের বসবাসও এই পানির জন্যই শুরু হয়েছিল। ১৯২০ এর দশকে হরিণের পালের পানির কথা চিন্তা করেই এখানে এসে বসবাস শুরু করেন পশুপালকরা।

আপনি যদি ওইমিয়াকনকে বর্তমান বিশ্বের মাপকাঠিতে বিচার করেন, তাহলে দেখবেন যে এখানে যারা থাকেন, তারা পার্শ্ববর্তী অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছে। অনেক আধুনিক জিনিসের দেখাই এ জায়গাটায় পাওয়া যায় না।

অনেক কিছুই প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য এখানে ব্যবহার করা যায় না। যেমন- মোবাইল ফোন কাজ করে না এ জায়গাটায়। একে তো নেটওয়ার্ক নেই। তার ওপর তীব্র ঠাণ্ডায় মোবাইল ডিভাইসও কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

এখানের বাসিন্দারা বাসার ভেতরটা গরম রাখতে কয়লা ব্যবহার করেন। প্রচুর কয়লা পোড়ানো হয় এই জায়গায়। শহরে দোকান আছে মাত্র একটা। সেখান থেকেই নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র কিনে থাকে মানুষ।

এ ছাড়াও ওইমিয়াকনে স্কুল আছে। স্কুল বছর জুড়ে মোটমুটি খোলা থাকে। শুধু তীব্র ঠাণ্ডার সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখানেও একটা মজার ব্যাপার হয়।

ওমিয়াকন যেহেতু অন্যান্য জায়গা থেকে বেশি ঠাণ্ডা, সেহেতু এখানের মানুষের সহনশীলতা অনেক বেশি। আর তাই স্কুল স্বাভাবিক ঠাণ্ডায় বন্ধ করে দেওয়া হয় না। তাপমাত্রা মাইনাস ৫২ ডিগ্রির নিচে চলে গেলেই শুধু স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই গ্রামটা গ্রীষ্মকালে ভালোই গরম থাকে। যেমন, অনেক সময় জুন, জুলাই ও অগাস্টে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও চলে যায়। গরমের সময় ওইমিয়াকনের অনেক বাসিন্দাই বিরক্ত হয়। তারা আসলে ঠাণ্ডায় এতোটাই অভ্যস্ত যে ওটাই পছন্দ করে।

গরমের সময় ওইমিয়াকনে দিনের সময়ও বেড়ে যায়। অনেক সময় টানা ২১ ঘণ্টা সূর্যের আলোয় আলোকিত থাকে পুরো এলাকা। তবে শীতকালের তুলনায় গরমকাল এখানে কম সময় থাকে।

ওইমিয়াকন কিন্তু নিজেদের সংস্কৃতি চর্চা থেকেও পিছিয়ে নেই। তাদের গ্রামে থিয়েটার ও জাদুঘর আছে। এ ছাড়াও শীতের শেষে ওইমিয়াকনে একটা উৎসব হয়। এটার নাম কোল্ড পোল ফেসটিভল।

এ ছাড়াও এ গ্রামটা নিজেদের এই অভিনব বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে পর্যটক টানার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এটার অবস্থান আসলে এতো ভেতরে যে এখানে যাওয়াটা বেশ কষ্টকর। এ ছাড়াও শীতের তাপমাত্রা তো একটা ভূমিকা রাখেই।

এবার আসুন আপনাকে ওইমিয়াকন যাওয়ার পথ বাতলে দেই। একেবারে হালকা শীতের সময়ও যদি আপনি ওইমিয়াকনে যেতে চান তাহলে আপনাকে প্রথমে পৌঁছাতে হবে ইয়াকুটস্ক শহরে। সেখানে বিমান থেকে নেমে গাড়িতে করে ওইমিয়াকন যেতে আপনার সময় লাগবে ২ দিন। আর যে রাস্তা দিয়ে যাবেন সেটা থাকবে পুরোটাই বরফে মোড়ানো।

এই ইয়াকুটস্ক শহরটাও কিন্তু ঠাণ্ডার জন্য বিখ্যাত। আমি শুরুতেই এই শহরটার কথা বলেছি। এখানেও বেশির ভাগ সময় তাপমাত্রা মাইনাস ৩০-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। অনেক সময় মাইনাস ৫০ ডিগ্রিতেও চলে যায়। কিন্তু তারপরও এটার অবস্থা ওইমিয়াকন থেকে তুলনামূলকভাবে ভালো!

আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।