মস্তিষ্কের গোপন ফিল্টার

মস্তিষ্কের গোপন ফিল্টার : যা আপনার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে অনেক কিছু

ধরুন আপনি নতুন একটা শার্ট কিনেছেন। দেখতে শুনতে ভালো, পরেও আরাম, ডিজাইনও অভিনব। কিন্তু কেনার পর অদ্ভুত ঘটনা শুরু হলো। আপনি যেদিকেই তাকান, সেদিকেই আপনার নতুন শার্টের মতো পোশাক দেখতে পান।

উপরে যে উদাহরণটি বললাম, এটি যে শুধু শার্টের বেলায় খাটে তা না। এটি অনেক কিছু নিয়েই হতে পারে। আপনি নতুন স্মার্টফোন কিনতে পারেন, তারপরে আবিষ্কার করতে পারেন যে আপনার আশপাশে অনেকেই একই মডেলের স্মার্টফোন চালাচ্ছে।

এই যে অদ্ভুত ঘটনা, এটি আসলে খুব জাদুকরি কিছু না। এটা মূলত আপনার মস্তিষ্কের একটা খেলা।

মানুষ হিসেবে আমরা প্রতিদিন লাখ লাখ জিনিসের সম্মুখীন হই। আমাদের পাশে বিভিন্ন রংয়ের, গন্ধের, আকারের অসংখ্য জিনিসপত্র থাকে। এখন একজন মানুষ যদি সবকিছুর দিকে মনোযোগ দেয়, তাহলে তার পক্ষে দৈনন্দিন কাজ করাই কঠিন হয়ে যাবে।

আর এই বিষয়টার সমাধানই আমাদের অলক্ষ্যে করে দেয় আমাদের মস্তিষ্ক। মানব মস্তিষ্কের একটা ফিল্টারিং প্রক্রিয়া আছে। ওই ফিল্টারিং প্রক্রিয়ায় একজন মানুষের জন্য যা প্রয়োজন বলে মনে করে মস্তিষ্ক, শুধু সেটাই তাকে সে দেখায়। বাদবাকি জিনিসগুলো অপ্রয়োজনীয় হিসেবে ধরে আড়াল করে রাখে।

এখন আপনার প্রশ্ন করা স্বাভাবিক যে মস্তিষ্ক কীভাবে ধরে নেয় যে কোনটা প্রয়োজনীয়, আর কোনটি অপ্রয়োজনীয়? মজার ব্যাপার হলো, এটি আপনিই সচেতনভাবে করে দেন।

একজন মানুষ সচেতনভাবে তার মনোযোগ যেসব বিষয়ের প্রতি দেয়, মস্তিষ্কের কাছে সেগুলোই প্রয়োজনীয়। বাদবাকি সব অপ্রয়োজনীয়।

ফলে আপনি যখন নতুন একটা শার্ট, স্মার্টফোন বা অন্য কিছু কেনেন, তখন আপনার মস্তিষ্ক সংকেত পায় যে এটি প্রয়োজনীয়। আর ঠিক ওই সময় থেকে সে আপনার আশপাশে এ ধরনের যা যা আছে, সেগুলো সম্পর্কে আপনাকে সচেতন করতে ও দেখাতে শুরু করে।

বিষয়টা এমন নয় যে সেগুলো আগে ছিল না। সেগুলো আগে থেকেই ছিল। সবসময়ই ঘুরতো আপনার আশপাশে। শুধু আপনি দেখতেন না। আপনার মনোযোগের বাইরে থাকতো।

এক কথায় বললে, আপনি যে জিনিসে মনোযোগ দিবেন, সেটিই আপনার মস্তিষ্ক আপনাকে বেশি দেখাবে। সেটির অস্তিত্ব সম্পর্কে আপনাকে ক্রমাগত অবহিত করবে। মস্তিষ্ক নিজের যে অংশটির মাধ্যমে এ ফিল্টারিংয়ের কাজটি করে, সে অংশটির নাম রেটিকুলার অ্যাক্টিভেটিং সিস্টেম বা আরএএস।

এই বিষয়টা এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে আগের তুলনায় আরও বেড়েছে। বরাবারই মার্কেটিং কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে জানতো। তারা এখন এটির সুযোগ আরও ভালোভাবে নিতে পারে।

ছোটবেলা থেকে প্রায়ই আমরা একটা কথা শুনেছি যে ভালো ভাবলে ভালো হয়, খারাপ ভাবলে খারাপ। বিষয়টাকে যদি আপনি মস্তিষ্কের এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেন, তাহলে দেখবেন যে এর আসলেও একটি যৌক্তিক ভিত্তি আছে।

এই যে মস্তিষ্ক আমাদের সাথে এ খেলাটা খেলে, এটির কিন্তু একটা গালভরা নাম আছে। এটাকে বলে, ফ্রিকোয়েন্সি ইলিউশন। এটা দুই ধাপে হয়। প্রথম ধাপে আপনার মস্তিষ্ক ওই জিনিসগুলোকে নির্বাচিত করে, যেগুলো আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই ধাপটাকে বলে সিলেকটিভ অ্যাটেনশন। আর দ্বিতীয় ধাপটি হলো কনফারমেশন বায়াস। আপনি ওই নির্বাচিত বিষয়টিকে যতোবার নিজ আশপাশে দেখতে পান, ততোবার আপনি আশ্বস্ত হন যে এটি সব স্থানে ছড়িয়ে আছে। এমনকি অনেক সময় এটি থাকেও না। আপনার মস্তিষ্ক প্যাটার্ন খুঁজে নেয়।

বিষয়টা আরও পরিষ্কার করতে আবারও শার্টের উদাহরণে ফেরত যাই। ধরুন আপনি যে শার্টটি কিনেছেন সেটি নীল রংয়ের। ফলে আপনার মস্তিষ্ক আপনাকে যখন চারপাশের নীল রংয়ের সব শার্ট দেখাতে শুরু করে, তখন আপনি সেটির সঙ্গে নিজের শার্টের মিল খুঁজতে শুরু করেন এবং মিল খুঁজেও পান। এভাবে এক পর্যায়ে আপনার মাথায় আসে, আরে আমি যে জিনিসটা কিনেছি, এটা তো এতো অভিনব না। আরও আছে চারপাশে!

মজার বিষয় হলো, আপনি চাইলেও এ ফিল্টার কখনও বন্ধ করতে পারবেন না। তবে আপনি চাইলে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন এবং নিজের লক্ষ্য অর্জনে কাজে লাগাতে পারবেন। মোটাদাগে তিনটা কাজ আছে, যেগুলোর মাধ্যমে এটি করা সম্ভব।

প্রথমটি হলো দিনের শুরুতে নিজের জন্য একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা। এতে করে আপনার মস্তিষ্ক সারাদিন সেটিকে অগ্রাধিকার দেবে এবং ওই সংক্রান্ত যা আপনার চারপাশে থাকবে, সেটি সম্পর্কে আপনাকে অবহিত করতে থাকবে।

দুই. ডায়েরি লিখুন। দিনশেষে দম নিন। ডায়েরি লিখুন। এতে করে আপনি সচেতনভাবে নিজের জীবনের কিছু প্যাটার্ন খুঁজে পাবেন। পরে সেটিকে বদলে দেওয়া আপনার জন্য সহজ হবে।

তিন. মেডিটেশন করুন। ইবাদত ও প্রার্থনা করুন। এতে করে আপনার মন শান্ত হবে। আপনার মস্তিষ্কও আপনার জন্য কোন জিনিসগুলো প্রয়োজন, তা সহজে নির্বাচন করতে পারবে এবং যেটি আপনার জন্য আসলেই প্রয়োজন সেটিকে অগ্রাধিকার দিতে পারবে।

বিষয়টা এমন নয় যে আপনি আজ থেকে শুরু করলে, আজকেই তাৎক্ষণিকভাবে ফলাফল পেয়ে যাবেন। কিছুটা সময় লাগবে। তবে টানা এ কাজগুলো করলে দেখবেন নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই চলে এসেছে। আর মস্তিষ্ক কীভাবে কী করছে, সেটিও আপনি ধরতে পারছেন।

আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।