স্কুইড গেইম

দক্ষিণ কোরিয়ার যে ‘বাস্তবতা’ তুলে ধরেছে স্কুইড গেইম

হাল আমলের জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ স্কুইড গেইম। বিশ্বের অগণিত মানুষ এই টিভি সিরিজ গোগ্রাসে গিলেছেন।

এর গল্প এতোটাই আকর্ষণীয় যে চাইলেও এ থেকে চোখ সরানো যায় না। এক এপিসোড আরেক এপিসোডের দিকে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু এই স্কুইড গেইমের পেছনেই লুকানো রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার নিদারুণ এক বাস্তবতা। আসলে সব টিভি, ওয়েব সিরিজ ও সিনেমাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সমাজের কোনো না কোনো বাস্তবতা থেকে প্রভাবিত হয়ে তৈরি হয়। স্কুইড গেইমের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

তাহলে স্কুইড গেইম আসলে কোন বাস্তবতার কথা বলছে? স্কুইড গেইম মূলত তুলে ধরছে দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজের এক বৈষম্য ও প্রতিযোগিতার কাহিনী, যা সমাজটিকে ভেতর থেকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে এবং সেখানের অনেক মানুষের জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বিষয়গুলো উঠে এসেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে প্রতিযোগিতা অকল্পনীয়। সেখানে একজন মানুষের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ধরা হয় – ইউনিভার্সিটি প্লেসমেন্ট এক্সামকে। মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার একজন মানুষ জীবনে সফল হবেন না কি ব্যর্থ, তা এই পরীক্ষা ঠিক করে দেয়। এই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে কখনও কখনও শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন ১২ ঘণ্টারও বেশি শুধু পড়ালেখার পেছনে ব্যয় করে।

পরীক্ষার দিন দেশটিতে থাকে থাকে সাজসাজরব। মোটামুটি সবই বন্ধ রাখা হয় যাতে পরীক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা না হয়। এমনকি আকাশে বিমান চলাচলও নির্দিষ্ট সময় বন্ধ রাখা হয়, যাতে পরীক্ষা দেওয়ার সময় কোনো শিক্ষার্থীর মনোযোগ নষ্ট না হয়।

আর এ পরীক্ষার প্রস্তুতি যে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার আগ দিয়ে নেওয়া হয়, তা নয়। দেখা যায়, বহু আগে থেকেই একজন শিক্ষার্থী এ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কারণ এ পরীক্ষার ফলাফল যে তার জীবনমান নির্ধারণ করে দেবে। এটি তার জন্য বাঁচামরার শামিল।

ফিরে আসি স্কুইড গেইমে। স্কুইড গেইমে অংশ নেওয়া প্রতিযোগীদের মধ্যে যে বেতনভোগী কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক, ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রতারক – দেখা যায়, এটি কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার খুব স্বাভাবিক বাস্তবতা। তাদের সমাজে এ ধরনের মানুষগুলো রয়েছে। স্কুইড গেইমে দেখানো ঘটনাগুলোর সঙ্গেও দক্ষিণ কোরিয়া ঘটে যাওয়া অনেক কিছুর মিল রয়েছে।

যেমন- মূল চরিত্র সিওঙ গি-হুনের অতীত জীবন হিসেবে দেখানো হয় যে তিনি কারখানার শ্রমিক ছিলেন। তাকে চাকরি হারাতে হয়েছিল। পরে সে প্রতিবাদেও রাস্তায় নেমেছিল। এই প্রত্যেকটা ঘটনাই দক্ষিণ কোরিয়ায় ঘটেছে। ২০০৯ সালে দেশটির সাঙ ইয়োঙ মোটর ফ্যাক্টরিতে এভাবে শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়েছিল। পরে শ্রমিকরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। এক পর্যায়ে তাদেরকে পুলিশের লাঠিপেটার মুখে পড়তে হয়েছিল। ব্যাপক সংঘাতও হয়েছিল সে সময়। এখনও দেশটি ওই ঘটনাকে মনে রেখেছে শ্রমিকদের সংঘাতময় একটি দিন হিসেবে।

এ কারণেই হয়তো চলচ্চিত্রপ্রেমী জিওঙ চিওল স্কুইড গেইমের রিভিউ লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘নাটকটি হয়তো কাল্পনিক হতে পারে, কিন্তু এটি বাস্তবের চেয়েও বেশি বাস্তব বলে মনে হয়েছে। অনিশ্চিত শ্রম, তরুণদের বেকারত্ব, ভেঙে যাওয়া পরিবার – এগুলো শুধু গল্পের প্লট নয়। এগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গল্প, যেগুলো মুখোমুখি আমরা প্রতিনিয়তই হই।’

কোরিয়ানরা বিষয়গুলো ভালোভাবেই অনুভব করতে পেরেছেন। আর তাই হয়তো স্কুইড গেইমের সিজন থ্রির ইউটিউব ভিডিওর কমেন্টে এক ব্যক্তি লিখে রেখে গেছেন, ‘আমার মনে হয় স্কুইড গেইম কোরিয়ানদের আসল ও ভেতরের মূল অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করে দিয়েছে। এটি বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে। বাস্তব জীবনে, কাজে বেপোরোয়া মানুষ শুধু অপেক্ষায় রয়েছে আপনাকে পিষে ফেলার জন্য। এই টিভি শো’তে তা সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।’

শুধু যে পড়ালেখা বা চাকরি নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ানদের ভুগতে হয়, তা নয়। একটা লম্বা সময় পর্যন্ত তারা চাইলেও নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে পারতো না, যদি সে পছন্দের মানুষের নামের শেষাংশ তার নামের সঙ্গে মিলে যেতো। এখন সে নিয়ম উঠে গেছে। তবে জীবন হয়ে উঠেছে আরও যান্ত্রিক। ফলে অনেক দক্ষিণ কোরীয় বিয়ে করার সাহস করে উঠতে পারেন না। অনেকের আবার জীবনের এসব বাস্তবতার মুখে ঘর ভাঙছে।

যা-ই হোক স্কুইড গেইম সফল। তারা বিশ্বব্যাপীই সাড়া ফেলেছে। এখন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে যে এটির আরেক কিস্তি আসলেও আসতে পারে। এমনটাও শোনা যাচ্ছে যে এবার এটির একটি মার্কিন স্পিনঅফ তৈরি হবে, যেটির গল্পের পুরোটাই তৈরি হবে আমেরিকার মাটিতে।

২০২১ সালে মুক্তি পাওয়া এ সিরিজ তৃতীয় সিজন নিয়ে এরই মধ্যে দর্শকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে বলেছেন, মূল চরিত্রের যে আত্মত্যাগ দেখানো হয়েছে, তা ঠিক সিরিজটার মূল থিমের সঙ্গে যায় না। অনেকে আবার সাধুবাদ জানিয়েছেন।

সিরিজটির নির্মাতা হঙ ডাক-হিউক অবশ্য সাংবাদিকদের বলেছেন, সিরিজটি নিয়ে যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে তা তিনি বুঝতে পারছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘প্রথম সিজনে কারো কোনো প্রত্যাশা ছিল না, ফলে এটি যে ধাক্কা ও নতুনত্ব নিয়ে এসেছিল, তা কাজ করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় সিজন নাগাদ প্রত্যাশা আকাশচুম্বী হয়েছে, আর এটাই সবকিছু বদলে দিয়েছে।’