‘আমরা কোথা থেকে এসেছি, সেটা বড় কথা নয়—কিন্তু কোথায় যাচ্ছি, সেটাই আসল।’
কথাটি লেখা রয়েছে পর্তুগালের একটি ছোট্ট ফুটবল ক্লাব গোন্দোমার এসসি-র অ্যাকাডেমির প্রবেশপথে। তার ঠিক পাশেই ফুটবল তারকা দিয়োগো জোতার দুটি ছবি—একটিতে তিনি গোন্দোমারের জার্সিতে, অন্যটিতে পর্তুগালের জাতীয় দলের হয়ে মাঠে।
এ যেন চোখে আঙুল দিয়ে বলে দেয়, কতটা দূর পথ পাড়ি দিয়েছেন জোটা। ২০২২ সাল থেকে ক্লাবটির নামকরণ করা হয়েছে “দিয়োগো জোতা অ্যাকাডেমি” নামে।
তবে এই দূরত্ব শুধু মাইলের হিসেবে নয়—এটি এক মানসিক দৃঢ়তা, সংগ্রামের এবং কখনও না থেমে চলার গল্প।
প্রেরণার প্রতীক হয়ে ওঠা এক ফুটবলারের জীবন
মাত্র ২৮ বছর বয়সে গাড়ি দুর্ঘটনায় ভাই আন্দ্রে সিলভাসহ স্পেনে মৃত্যুবরণ করেছেন দিয়োগো জোতা। তার এই অকালপ্রয়াণে শুধু গোন্দোমার বা পর্তুগাল নয়—পুরো ফুটবল বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে গেছে। কারণ তিনি ছিলেন প্রমাণ, যে শুধু প্রতিভা নয়, একনিষ্ঠতা, পরিশ্রম ও মানসিক দৃঢ়তা থাকলেই একদম শূন্য থেকে শিখরে ওঠা সম্ভব।
ছোটবেলায়, গোন্দোমারের তৃতীয় বিভাগীয় ক্লাবে খেলতে মাসে ২০ ইউরো করে দিতে হতো পরিবারকে। শারীরিক গড়নের কারণে বড় ক্লাবগুলো তাকে শুরুতে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। খেলে যেতে থাকেন। আসলে তার মধ্যে ‘আমি পারব’ বিশ্বাসটা পুরোদমেই ছিল।
জোতা একসময় প্যাকোস ডি ফেরেইরায় খেলতে গিয়ে নজরে আসতে থাকেন। তার পায়ের জাদু দেখে সে সময় পতুর্গালের সাবেক ফুটবলার ও কোচ জর্জ সিমাও এক সাহসী মন্তব্য করেন, “এই ছেলেটিই হয়তো হয়ে উঠবে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর উত্তরসূরি।”
এটা শুনে কিছুটা থমকে যান জোতা, একটু অবাকও হন। মনের মধ্যে তখনই বিশ্বাসের নতুন স্তর চলে আসে, “যদি ও বিশ্বাস করে আমি পারি, তাহলে আমিও তো সেটা ভাবতে পারি!”
সেখান থেকেই শুরু হয় জোতার আরও এক নতুন যাত্রার।
এখানে বলে রাখা ভালো, পর্তুগালের বড় তিন ক্লাব বেনফিকা, স্পোর্টিং কিংবা পোর্তো —কোনোটিই জোতার শৈশব গড়ে দেয়নি। তাই তাকে বলা চলে নিজেকে নিজেই গড়ে তোলার এক বিরল দৃষ্টান্ত। জোতা ছিলেন মাথার উপর বড় ছায়া ছাড়া, নিজেই নিজের আলোর উৎস হয়ে ওঠা এক ফুটবলার।
‘আমি বিদেশে খেলব’, বলেছিলেন একদিন, নিজেই তৈরি করেছিলেন পথ
প্যাকোসে থাকাকালীন একদিন যুব ফুটবল কো-অর্ডিনেটর জিলবার্তো আন্দ্রাদের কাছে আসেন জোতা। এসেই করেন অদ্ভুত এক অনুরোধ —“আমি একটি বিদেশি ভাষা শিখতে চাই। একদিন আমি বিদেশে খেলতে পারি, প্রস্তুত থাকতে হবে।”
সে সময় আন্দ্রাদে কিছু অডিও কোর্স দেন, কিন্তু জোতা বুঝে যান যে এগুলো যথেষ্ট নয়, তার আসলে একজন শিক্ষক প্রয়োজন। এটাই ছিল তার ভিন্নতা। নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারা এবং সে সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠার মতো দৃঢ়তা ও পথ খুঁজে পাওয়ার মতো বিচক্ষণতা ছিল জোতার মধ্যে। তিনি এর প্রমাণ বারবার দিয়েছেন নিজের ২৮ বছরের জীবনে এবং খেলার মাঠে।
তিনি জানতেন কোথায় যাচ্ছেন। নিজেকে গড়েপিটে নিচ্ছিলেন সেভাবেই। ছোট ক্লাবের বাইরে ভবিষ্যৎ খুঁজে নিতে চাইলে শুধু বলেই নয়, মনেও প্রস্তুত থাকতে হয়। জোতা সেটাই করেছিলেন।
ক্লাব ডরমিটরিতে থাকা একমাত্র সিনিয়র খেলোয়াড়
জীবনের এক অলঙ্ঘনীয় নিয়ম হলো- এটি আপনাকে কষ্টিপাথরের মতো যাচাই করবে। আপনি বড় ফুটবলার, তারকা না কি সাধারণ মানুষ, সেটি তার দেখার বিষয় নয়। জীবন আপনার পরীক্ষা নিবেই।
২০১৪-১৫ মৌসুমের শুরুতে মেডিকেল পরীক্ষায় জোতার হৃদপিণ্ডে সমস্যা ধরা পড়ে। চিকিৎসকরা তাকে এক মাসের জন্য ট্রেনিং বন্ধ রাখতে বলেন। জোতার আশপাশের অনেকেই তখন চিন্তায় পড়ে যান, ক্যারিয়ার কি তাহলেই এখানেই থেমে গেলো?
তখন জোতা শুধু বলতেন, “ঘোড়ার সামনে গাড়ি জুড়ো না।” এক কথায়, তার সামনে প্রতিবন্ধকতা এনে হাজির করতে মানা করতেন।
এমনই অদম্য ছিল এই ফুটবলারের দৃষ্টিভঙ্গি। প্রতিদিন এক ধাপ, এক লক্ষ্য – এভাবেই আগাতে চাইতেন তিনি।
সাদামাটা জীবন ছিল জোতার। তিনি যখন ক্লাবের সিনিয়র দলে জায়গা পান, তখনো তিনি ডরমিটরিতেই থাকতেন। সেখানে একসঙ্গে ট্রায়ালিস্ট ও জুনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গে মিলেমিশে তার দিন কাটতো। তিনিই ছিলেন একমাত্র সিনিয়র ফুটবলার, যিনি এতোটা সাধারণ জীবনযাপন করতেন।
“নিজের ঘরেই থাকতেন, বাইরের জগৎ তার মনোযোগ কেড়ে নিতে পারত না। পুরোপুরি খেলার প্রতি নিবেদিত ছিলেন,” পুরোনো স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে বলেন আন্দ্রাদে।
তার প্রস্থানে শূন্যতা নয়, উদাহরণ রেখে গেলেন
যেসব খেলোয়াড় সাফল্য পেলে দিশা হারান, দিয়োগো জোতা ছিলেন তার ঠিক উল্টো উদাহরণ। অর্থ আসার পরও বিনয়, সংযম বা পরিশ্রম – কোনোটাতেই কোন ঘাটতি পড়েনি।
তিনি বেছে নিয়েছিলেন সুবিবেচকের জীবন। সাহায্য করেছেন আশেপাশের মানুষদের, জ্ঞানে বিনিয়োগ করেছেন, নিজের পেছনেও সময় ব্যয় করেছেন। ভবিষ্যতের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছেন।
যার প্রমাণ—পোর্তো থেকে উলভারহ্যাম্পটন, সেখান থেকে লিভারপুলের মতো ক্লাবে গিয়ে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করা। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া, সুইডেনের বিপক্ষে নেশনস লিগে জোড়া গোল করে ঐতিহাসিক জয় এনে দেওয়া। এবং সেই সময়ই বলা সেই বিখ্যাত কথা—“আমরা কোথা থেকে এসেছি, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো- আমরা কোথায় যাচ্ছি।”
শুরুর স্থান নয়, যাত্রাটাই আসল
দিয়োগো জোতার জীবন যেন এক চলমান পাঠ্যপুস্তক। কীভাবে সীমাবদ্ধতা জয় করতে হয়, কীভাবে উচ্চতা ছুঁতে হয় মাটিতে পা রেখেই, তা যেন দিয়েগো জোতার চেয়ে ভালোভাবে বলা সম্ভব নয়।
গোন্দোমার থেকে শুরু, কিন্তু নিজেকে মেলে ধরেছিলেন বিশ্বমঞ্চে।
তার মৃত্যু হৃদয়বিদারক, কিন্তু তার রেখে যাওয়া অনুপ্রেরণা আরও অনেক তরুণকে সাহস দেবে। তার কথা, জীবনদর্শন ও রেখে যাওয়া পদচিহ্ন নতুন প্রজন্মের জন্য পথ দেখাবে।
জোতার গল্পই প্রমাণ করে, শুরুটা কোথা থেকে হয়েছে সেটা বড় নয়। কিন্তু সৎভাবে, ধৈর্য নিয়ে, একাগ্রতা ধরে রাখলে গন্তব্যও একদিন হাতের মুঠোয় ধরা দেয়।
তিনি হয়তো আর নেই, কিন্তু তার যাত্রা অনেককেই বলবে: ‘তুমি পারবে।’
লেখাটি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনের আলোকে লেখা
আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।





