১৯৮৫ সালের ৩ জুলাই। হলঘরগুলোতে তখন সবে গ্রীষ্মের হাওয়া, সিনেমা ব্যবসার ব্যস্ত সময়। ঠিক তখনই মুক্তি পায় একটি ছবি—Back to the Future। প্রথম দর্শনে অনেকের কাছেই এটি ছিল কৌতুকের মোড়কে মোড়া বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। কিন্তু যতই সময় গড়ায়, এটি হয়ে ওঠে একটি সংস্কৃতি, একটি সময়ের প্রতীক, এমনকি সময়কে ছাড়িয়ে যাওয়া এক অনন্য গল্প।
চার দশক পরেও সেই একই উত্তেজনা, সেই একই বিস্ময়—যেন গল্পটা এখনও চলছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সিনেমাটি দেখছে, মুগ্ধ হচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, সিনেমাটি আরেকটু হলে তৈরিই হতো না!
জন্ম এক ‘টাইম ট্রাভেল’ আইডিয়ার
সিনেমাটির চিত্রনাট্যের সহ-লেখক বব গেইল ও পরিচালক রবার্ট জেমেকিস বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী ছিলেন। শুরুতে টিভির জন্য কিছু স্ক্রিপ্ট লিখে তারা প্রযোজনা সংস্থা ইউনিভার্সেলের নজরে আসেন। তাদের মাথায় আগে থেকেই একটা আইডিয়া ঘুরপাক খাচ্ছিল। বরাবরই সময়ভিত্তিক কোনো গল্প বানাতে চেয়েছিলেন দু’জন।
এই স্বপ্ন একদিন বাস্তব রূপ নেয় গেইলের বাবার হাইস্কুল ইয়ারবুক থেকে। “একটা ছেলে যদি অতীতে ফিরে গিয়ে নিজের বাবার ক্লাসমেট হয়ে যায়, কেমন হয়?”—এই প্রশ্নই বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো মাথায় আসে গেইলের।
ব্যস শুরু হয় ব্যাক টু দ্য ফিউচার লেখার কাজ। সিনেমায় দর্শকরা ডক নামের যে আধ ক্ষ্যাপাটে বিজ্ঞানীর চরিত্রটি দেখতে পান, তিনিও কিন্তু গেইলের ছোটবেলা থেকেই ধার করা!
সহলেখক বব গেইল বলেন, ছোটবেলায় তার এক ফটোগ্রাফার প্রতিবেশী ছিলেন। সেই প্রতিবেশীর কাছে তিনি প্রথম “জাদু” দেখেন। ডার্করুমে ছবি তৈরি হওয়ার সেই মুহূর্ত গেইলের মনে দাগ কেটে যায়। সে সময় টিভিতেও Mr. Wizard নামে একটি শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান হতো। এটিরও প্রভাব পড়ে গেইলের উপর। দিনশেষে এই দুইকে মিলিয়ে গেইল তৈরি করেন ডক ব্রাউনের চরিত্র।
অন্যদিকে অভিনেতা ক্রিস্টোফার লয়েড যখন চরিত্রটিতে অভিনয় করেন, তখন তিনি এতে মিশিয়ে দেন আইনস্টাইন ও বিখ্যাত সিম্ফনি কন্ডাক্টর লিওপোল্ড স্টোকোস্কির মেজাজ।
এই মিশ্রণের ফলে জন্ম হয় ইতিহাসের অন্যতম প্রিয় বিজ্ঞানীর।
সহজ ছিল না পথ
স্ক্রিপ্ট তো তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু এটিকে সিনেমায় রূপ দেওয়া নিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়। স্ক্রিপ্ট নিয়ে স্টুডিও থেকে স্টুডিওতে ঘুরতে শুরু করেন গেইল ও জেমেকিস। ৪০ বার ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাদেরকে। কোনো স্টুডিও একে ঝুঁকিপূর্ণ, কেউবা আবার ‘উস্কানিমূলক’ বলে বাতিল করে দেয়।
শেষমেশ স্টিভেন স্পিলবার্গ এগিয়ে আসেন। ১৯৮৪ সালে জেমেকিসের পরিচালিত সিনেমা Romancing the Stone হিট করেছিল। ফলে ইউনিভার্সেল ছবিটি তৈরি কাজে হাত দিতে সাহস পায়, তারা সবুজ সংকেত দিয়ে দেয়। এরপর শুরু হয় সেই জাদুময় যাত্রা।
এক ‘ভুল’ মার্টি থেকে সঠিক মার্টি
প্রথমদিকে কেন্দ্রীয় চরিত্র মার্টির জন্য নেওয়া হয়েছিল এরিক স্টল্টজকে। কিন্তু প্রোডাকশন শুরুর পর বুঝা গেল—স্টল্টজ চরিত্রটিকে খুব বেশি সিরিয়াসভাবে নিচ্ছেন। তার অভিনয়ে কৌতুক ছিল না, ছিল এক ধরনের ট্র্যাজিক বোধ।
গেইল বলেন, “তিনি ভাবতেন এটা ট্র্যাজেডি—কারণ মার্টি ফিরে যায় এমন এক ১৯৮৫-তে, যা তার অতীতের চেয়ে ভিন্ন। অন্যদিকে আমাদের কাছে তো কৌতুক লাগছিল, কিন্তু উনি ভাবলেন ট্র্যাজেডি!”
শেষমেশ মাইকেল জে ফক্সকে আনা হয়। জে ফক্স তখন অত্যন্ত ব্যস্ত। Family Ties–নামের একটা সিরিজে কাজ করছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের হতাশ করলেন না। দিনে সিরিজ, রাতে সিনেমা— এভাবে সমানতালে চালিয়ে গেলেন দুটার কাজ। ক্লান্ত হলেও, তার রসবোধ, বাচালতা আর প্রাণশক্তি সিনেমায় নতুন প্রাণ আনল।
নিখুঁত মিলনে গড়া এক অসম্ভব সুন্দর জগৎ
ছবির অভিনেত্রী লিয়া থম্পসন বলেন, “আমি এখন বুঝি, কেন Back to the Future প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দর্শকদের মুগ্ধ করে। গল্প, অভিনয়, কাস্টিং—সব কিছু একসঙ্গে ঠিকঠাক মিলে গিয়েছিল। এমনটা সচরাচর ঘটে না।”
এবং তার কথাই যেন সত্যি। সিনেমাটির প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি সংলাপ যেন ঘষেমেজে তৈরি—কোথাও বাড়তি কিছু নেই, কোথাও কমতি নেই।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখেও ব্যাক টু দ্য ফিউচারের সংলাপ
এখন আপনাদের একটি মজার তথ্য দেই। সিনেমাটি যে শুধু সাধারণ দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল, তা নয়। এটি মুগ্ধ করেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্টকেও।
ছবির একদম শুরুর দিকের একটি দৃশ্য এরকম ছিল যে – ডক ব্রাউন বিস্ময়ে বলে ওঠেন—“রোনাল্ড রেগান? প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছেন? অভিনেতা রেগান? তাহলে ভাইস প্রেসিডেন্ট কে? জেরি লুইস?”
সিনেমার পর্দার এই রসিকতা পছন্দ হয়ে গিয়েছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রেগানের। তিনি এতোটাই মজা পেয়েছিলেন প্রজেকশন রুমে সিনেমা থামিয়ে দৃশ্যটা আবার দেখতে বলেন।
এমনকি পরের বছর নিজের State of the Union ভাষণে এই সিনেমার লাইন উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেন,“Where we’re going, we don’t need roads.”
একটা সিনেমা, যা প্রেসিডেন্টের ভাষণে জায়গা করে নেয়—এর চেয়ে বড় সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি আর কী হতে পারে?
“To Be Continued” ছিল না মূল ছবিতে
ছবির শেষ দৃশ্যে ডক ব্রাউন ডেলোরিয়ান গাড়িতে মার্টি ও জেনিফারকে নিয়ে উড়ে যান। আমরা যারা ভিএইচএস ক্যাসেটের যুগে বড় হয়েছি, তারা জানি যে এরপর স্ক্রিনে ভেসে উঠত—“To Be Continued”। এমনকি সিডি, ডিভিডি সংস্করণেও এ লেখাটি আছে।
কিন্তু সেই লাইনটি মূল সিনেমায় ছিল না! পরে হোম ভিডিওতে যখন সিনেমাটি মুক্তি দেওয়া হচ্ছিল, তখন এটি যোগ করা হয়। মূলত দ্বিতীয় কিস্তির ইঙ্গিত হিসেবেই এটি দেওয়া হয়েছিল।
আজকের দিনে হলে হয়তো হতোই না
গেইল বলেন, “এই ছবিটা আজকের দিনে হয়তো কেউ বানাত না। মার্টি ও ডকের বন্ধুত্ব নিয়ে আজকাল নানা ভুল ব্যাখ্যা হত। অথচ এটা ছিল নিখুঁতভাবে নির্দোষ। সবাই মিলেই এক দুর্দান্ত গল্প বলেছিলাম আমরা।”
গেইলের মতে, সময় ভ্রমণের গল্প হলেও এর মধ্যে ছিল আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন, ভবিষ্যতের আশা এবং অতীতের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সম্ভাবনা।
সময়ের গন্ডি পেরিয়ে যাওয়ার কারণ
ব্যাক টু দ্য ফিউচার এখনো যতবার দেখা হয়, মনে হয় যেন নতুন করে শুরু হল এক আশ্চর্য যাত্রা।এটি শুধু একটা সিনেমা নয়—এটি আশাবাদের, নতুন সুযোগের, আর প্রতিটি দর্শকের জন্য প্রশ্ন তোলার গল্প। এটি যেন আমাদের কাছে জানতে চায়, “যদি তুমি অতীতে ফিরে যেতে পারতে, তুমি কী বদলাতে চাইতে?”
৪০ বছর পরেও এই প্রশ্নটাই হয়তো সিনেমাটিকে রেখেছে অনন্যতায়।
এটি এখন আর সময়-ভ্রমণের গল্প নয়, সময়-জয় করার গল্প।
আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।








