হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর শহর পেনিকো

হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর শহর পেনিকো

নতুন একটি শহর খুঁজে পাওয়া গেছে — প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পুরোনো! পেরুর উত্তরের বারাঙ্কা প্রদেশের পাহাড়ি এক জায়গায় আবিষ্কৃত এই প্রাচীন শহরের নাম পেনিকো (Peñico)। শুনতে গল্পের মতো শোনালেও, ঘটনা পুরোপুরি সত্য।

এ যেন ইতিহাসের পাতায় ধুলোমাখা এক পরিত্যক্ত অধ্যায়, যেটা হঠাৎ করেই চোখে পড়ে গেছে একদল পুরাতত্ত্ববিদের। আর সেই পাতাটাকে উল্টে দেখতে গিয়ে সামনে চলে এসেছে এক বিস্ময়কর অতীত।

পাহাড়ের কোলে, ইতিহাসের সীমানায়

লিমা শহর থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার উত্তর দিকে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই শহর। প্রাথমিক বিশ্লেষণে ধারণা করা হচ্ছে, পেনিকো গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে—যে সময়টায় বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠছিল মিসর, সুমের, ভারত আর চীনের প্রাচীন সভ্যতা।

ড্রোনের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে শহরের কেন্দ্রস্থলে এক গোলাকার কাঠামো, চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে পাথর আর মাটির তৈরি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ। এই ছবি যেন এক নীরব শহরের চিৎকার—“আমাকেও দেখো, আমিও ছিলাম।”

৮ বছরের গবেষণায় উঠে এল স্থাপনা

পুরো এলাকার ওপর টানা আট বছর ধরে খননকাজ চালিয়েছেন গবেষকেরা। এর মধ্যেই তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন অন্তত ১৮টি কাঠামো—অনুষ্ঠানভিত্তিক মন্দির, আবাসিক ভবন, এবং সামাজিক জমায়েতের জায়গা।

আরেকটা দারুণ ব্যাপার হলো—শুধু স্থাপনা নয়, সেই ভবনগুলোর ভেতর থেকে মিলেছে কাদামাটির তৈরি মানুষের ও পশুর মূর্তি, বিভিন্ন ধরনের নেকলেস, আর সমুদ্রের ঝিনুক দিয়ে তৈরি অলংকার। ভাবা যায়? পাহাড়ের কোলে বসেও তারা সমুদ্রের খোঁজ রেখেছিল।

ক্যারাল সভ্যতার উত্তরাধিকার?

এই পেনিকো শহরটি যেখানে পাওয়া গেছে, তার খুব কাছেই ছিল ক্যারাল (Caral) শহর। এটি ছিল আমেরিকার সবচেয়ে পুরোনো সভ্যতা, যার ইতিহাস প্রায় ৫,০০০ বছর আগের। ক্যারাল ছিল সুপে উপত্যকায় (Supe Valley), যেখানে বিশাল পিরামিড আকৃতির স্থাপনা, উন্নত কৃষি ব্যবস্থা এবং গোছানো নগরায়ন ছিল।

ক্যারাল শহরে রয়েছে ৩২টি স্থাপনা, যার মধ্যে রয়েছে বিশাল পিরামিড-আকৃতির কাঠামো, উন্নত সেচব্যবস্থা ও নগরায়ন। ক্যারাল সভ্যতা আজও গবেষকদের বিস্ময় জাগায় এই কারণে যে, এটি গড়ে উঠেছিল প্রায় একা-একা, বিশ্বের অন্য প্রাচীন সভ্যতাগুলোর (মিসর, ভারত, সুমের, চীন) প্রভাব ছাড়াই।

এখন ধারণা করা হচ্ছে, এই ক্যারাল সভ্যতারই উত্তরসূরীরা গড়ে তুলেছিল পেনিকো।

আবিষ্কারের নায়ক—রুথ শাদি

এই পেনিকো আবিষ্কারের মূল নেতৃত্বে ছিলেন ড. রুথ শাদি, যিনি নব্বইয়ের দশকে প্রথম ক্যারাল শহরের খনন কাজ শুরু করেছিলেন। রুথ শাদি বলেন, “ক্যারাল সভ্যতা আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তারপর কী ঘটেছিল—সেই শূন্যস্থান এখন পূরণ করছে পেনিকো।”

অর্থাৎ, পেনিকো একধরনের উত্তরাধিকার। এমন একটি শহর, যেখানে ক্যারালের কিছু মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল, নতুন করে জীবন গড়েছিল। তিনি বলেন, “পেনিকো ছিল এক কৌশলগত জায়গায়—সমুদ্র উপকূল, আন্দিজ পর্বত ও আমাজন বনের মাঝে বাণিজ্যের এক সেতুবন্ধন তৈরি করেছিল।”

সভ্যতার ‘ট্রেডিং হাব’

পেনিকোকে গবেষকেরা সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ “ট্রেডিং হাব” বা বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেই দেখছেন। পানির ধারা যেমন পাহাড় থেকে নেমে আসে সমুদ্রের দিকে, তেমনি এখানকার মানুষও ছিল সংযুক্ত। উপকূলীয় জনপদ, পাহাড়ের মানুষ আর অ্যামাজনের আদিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো তারা।

পুরোনো সভ্যতাগুলো যে কেবল ধর্মীয় বা স্থাপত্যশিল্পেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তারা অর্থনীতির দিক থেকেও উদ্ভাবনী ছিল- পেনিকো সেটিরেই এক প্রমাণ। এটি দেখিয়ে দিয়েছে যে—দূরের গ্রাম কিংবা নদীর তীরে থাকা মানুষও তখন একে অন্যের সঙ্গে আদান-প্রদান আর সহযোগিতার কথা ভেবেছিল।

আবারও প্রমাণ, পেরু শুধুই ইনকাদের দেশ নয়

আমরা অনেকেই পেরু বললেই কেবল মাচু পিচু আর ইনকা সভ্যতার কথা ধরে নেই। কিন্তু পেনিকো এই ধারণায় আঘাত হানছে। এটি বলে দিচ্ছে যে, পেরুর ইতিহাস শুরু হয়েছিল ইনকা রাজাদের অনেক আগেই।

ক্যারাল, পেনিকো—এরা যেন সেই প্রাচীন সময়ের আদি নকশা, যেখান থেকে আমেরিকার ইতিহাস সত্যিকার অর্থে শুরু হয়েছিল।

গোপন শহরের গায়ে ধুলোমাখা কাহিনি

প্রতিটি সভ্যতার পেছনে থাকে এক হারিয়ে যাওয়া শহরের গল্প। শহরটি ধ্বংস হয় কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে, কখনও যুদ্ধের তাপে, আবার কখনও সময়ের দখলে। কিন্তু সেই শহরের ইট-পাথরের ফাঁক দিয়ে কালের বিবর্তনে বের হয়ে আসে কিছু কিছু ইঙ্গিত। সেগুলো জানিয়ে দেয়, কে ছিল তারা, কীভাবে বাঁচত, কিসে বিশ্বাস করত।

পেনিকো এমনই এক শহর, যেটি হয়তো ৩,৫০০ বছর আগে একসময় বাঁচতে চেয়েছিল, ভাবতে চেয়েছিল, গড়তে চেয়েছিল সভ্যতা।

ইতিহাসের কাছে আমরা দায়বদ্ধ

পেরুর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের গবেষক ড. মার্কো মাচাকুয়াই বলেন, “পেনিকো ক্যারাল সভ্যতার একটি ধারাবাহিকতা। এটি আমাদের প্রাচীনতা এবং ধারাবাহিকতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করছে।”

তার এই কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে বড় এক বার্তা। তিনি বলতে চাইছেন, ইতিহাস কোনো বিচ্ছিন্ন গল্প নয়। এটি সময়ের প্রবাহে একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে।

শেষ কথা

পেনিকোর আবিষ্কার শুধু প্রাচীন শহরের তালিকায় নতুন নাম যুক্ত করেনি। এটি প্রশ্ন তুলেছে আমাদের জানার পরিধি নিয়েও? আমরা ঠিক কতটুকু জানি আমাদের পুরোনো পৃথিবীকে? কত গল্প এখনও ধুলো চাপা পড়ে আছে মাটির নিচে?

জানার শেষ নেই। কিন্তু প্রতিটি আবিষ্কার আমাদের আরও একটু কাছে নিয়ে যায় নিজেদের শেকড়ের কাছে, অতীতের দিকে। কারণ, প্রতিটি পেনিকো আসলে একটি হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর দরজা খুলে দেয়।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।