১৯৩৮ সালে সুপারম্যানের প্রথম সংখ্যা যখন প্রকাশিত হয়, তখন বিশ্ব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। গোটা বিশ্বই তেতে উঠছিল। এর আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রেও।
ইউরোপে তখন নাৎসি বাহিনী অস্ট্রেয়াতে আক্রমণ করে ফেলেছে। পোল্যান্ডের দিকে যাওয়ার তোরজোর করছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে না জড়ালেও, দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে তুমুল বিতর্ক।
সুপারম্যান সে সময় শুধু কমিক চরিত্রে আর সীমাবদ্ধ রইলো না। বরং বলা ভালো, থাকতে পারলো না। তাকে হয়ে উঠতে হলো এক অনুপ্রেরণার প্রতীক। বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ প্রথমে ধীরে এবং পরে জোরেশোরেই পড়ত শুরু করলো কমিক স্ট্রিপে।
কখনও দেখা যেতে থাকলো সুপারম্যান হিটলারের মতো এক প্রতিপক্ষকে ঘুষি মারছেন, কখনও আবার সে সান্তাকে উদ্ধার করে আনছে নাৎসিদের হাত থেকে। এমনকি এক পর্যায়ে যুদ্ধের বন্ড বিক্রির প্রচারণায় অংশ নিলো সুপারম্যান।
আর এভাবেই সম্পূর্ণ কল্পিত একটি চরিত্র হয়েও সুপারম্যান জায়গা করে নিলো বাস্তব দুনিয়ার ইতিহাসের পাতায়। সে-ও হয়ে উঠলো অবিচ্ছেদ্য একটা অঙ্গ, যা এতো বছর পরে এসেও ইতিহাস ঘাটলে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।
সুপারম্যানে ছদ্মনামে হিটলার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনমত ছিল দুইভাগে বিভক্ত। এক ভাগ ছিল যুদ্ধে জড়ানোর পক্ষে। অন্যভাগের কথা ছিল, এই যুদ্ধে জড়ানোর কোনো দরকার নেই, বরং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করাই উত্তম।
তবে সুপারম্যানের স্রষ্টা জ্যারি সিগেল ও জো শুস্টার ছিলেন ভিন্নমত পোষণকারী। তারা সরাসরি যুদ্ধের সমর্থনে কিছু না বললেও নিজেদের সৃষ্টি সুপারম্যানের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলেন বার্তা। অ্যাকশন কমিকসের ১৭ নম্বর পর্বে দেখা গেল সুপারম্যান এমন একদল সৈন্যের সাথে লড়ছেন, যারা দেখতে অনেকটা নাৎসি বাহিনীর মতোই। তাদের মাথায়ও নাৎসী বাহিনীর মতো হেলমেট রয়েছে।
তবে আরও প্রকাশ্যে হিটলারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে একটু সময় নিয়েছিল সুপারম্যান। শুরুতে সে লড়াই করছিল আড়ালে, আবডালে – বিভিন্ন ইঙ্গিত দিয়ে। সবাই বুঝছিল যে কার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সরাসরি তাদের নাম নেওয়া হচ্ছিল না।
যেমন – ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুপারম্যানকে হিটলারের মতো দেখতে এক ভিলেনের বিরুদ্ধে লড়তে দেখা যায়। কিন্তু তার নাম ছিল “অ্যামরক”, সে ছিল “ব্লিটজেন” নামের এক দেশের বাসিন্দা।
তবে এই রাখঢাকের অবসান ঘটলো তৎকালীন লুক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক বিশেষ স্ট্রিপে। সেখানে হিটলার ও স্তালিনকে সরাসরি সুপারম্যানের শত্রু হিসেবে তুলে ধরা হলো। স্ট্রিপে দেখা গেল, হিটলারের কলার চেপে ধরে সুপারম্যান হুমকি দিচ্ছেন, তাকে মারধর করছেন।
এই বার্তা ধীরে ধীরে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। অ্যাকশন কমিকসের ৪৩ নম্বর প্রচ্ছদেই (১৯৪০ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত) এক নাৎসি প্যারাট্রুপারকে গুলি ছুড়তে দেখা গেল সুপারম্যানের দিকে। ওই প্যারাট্রুপারের বাহুতে স্বস্তিকা চিহ্ন স্পষ্ট ছিল। পরের মাসেই আবার সুপারম্যানকে দেখা গেল নাৎসিদের কামানের নল ভেঙে দিতে।
এ পর্যায়ে এসে শুধু কমিক নয়, রেডিও, সিনেমার অ্যানিমেশনেও শুরু হলো সুপারম্যানের যুদ্ধ। একেবারে খোলাখুলিই সে নেমে গেলো এসব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে।
সুপারম্যান: প্রচারণারও নায়ক
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্কিন সরকার বুঝতে পারল যে সুপারম্যান শুধু শিশুদের বিনোদন নয়, তিনি হতে পারেন শক্তিশালী প্রচারণার মাধ্যমও। তাকে কাজে লাগানো হলো যুদ্ধের বন্ড ও স্ট্যাম্প বিক্রির কাজে।
পল এস. হিরশ্চ তার বই পাল্প এম্পায়ার -এ লিখেছেন, সে সময় রাইটার্স ওয়ার বোর্ড নামে একটি পরিষদ গড়ে উঠলো, যেটি ১৯৪৩ সাল থেকে কমিককে যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে ব্যবহার করতে শুরু করলো। এই পরিষদের খরচ যোগাতো মার্কিন সরকার।
সে সময় প্রায় অর্ধেক মার্কিন সেনা নিয়মিত কমিক পড়তেন। আর সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া কমিক ছিল সুপারম্যান। হিরশ্চ উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৪১ সালে শুধু সুপারম্যানেরই ১ কোটি কপি বিক্রি হয়েছিল। সেই সূত্রেই জন্ম নেয় বিখ্যাত স্লোগান: “সত্য, ন্যায়বিচার ও আমেরিকার পন্থা”। এই স্লোগান প্রথম প্রচারিত হয় দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব সুপার্যান রেডিও সিরিজে, ১৯৪২ সালে।
সুপারম্যান নিজেই কিন্তু একজন অভিবাসী। যিনি সুদূর ক্রিপ্টন থেকে এসে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছে। ফলে তিনি ছিলেন একদিক থেকে আদর্শ মার্কিন নায়ক।
একাই নন, একঝাঁক সুপারহিরো
যুদ্ধের সময় সুপারম্যানকে অবশ্য একাই লড়তে দেখা যায়নি। অন্যান্য কমিক চরিত্রকেও লড়তে দেখা গেছে। যেমন- ব্যাটম্যান, ওয়ান্ডার ওম্যান, সাব ম্যারিনার, ক্যাপ্টেন মার্ভেল, গ্রিন হর্নেট, হিউম্যান টর্চ, এমনকি ফ্রাঙ্কেইনস্টাইন পর্যন্ত একযোগে নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়েছেন।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া এসেছিল সুপারম্যানকে ঘিরেই। তার কারণ হয়তো এই যে, নাৎসিরা নিজেরাই ফ্রেডেরিক নিৎশের ‘উবারমেনশ’ ধারণাকে বিকৃত করে “মাস্টার রেস”-এর প্রচারণা তৈরি করেছিল। অন্যদিকে ‘সুপারম্যান’ শব্দটির মধ্যেই ছিল এক প্রতীকী সংঘর্ষ।
১৯৪০ সালের এপ্রিলে নাৎসি প্রচারযন্ত্র সরাসরি মৌখিকভাবে আক্রমণ করে বসে সুপারম্যানের স্রষ্টা জ্যারি সিগেলকে। তারা জানায়, সিগেল “ঘৃণা, অলসতা আর অন্যায়” ছড়াচ্ছেন আমেরিকার শিশুদের মধ্যে।
এক পর্যায়ে সুপারম্যান জাপানিদের সঙ্গেও লড়েছেন। তবু তার সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল নাৎসিরাই। লেখক হ্যারি ব্রড লিখেছেন, “যদিও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়ায় জাপানের হামলায়, তারপরও সুপারহিরোরা বেশি যুদ্ধ করেছে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে। কারণ এই কমিক সৃষ্টির পেছনে ছিলেন ইহুদি বংশোদ্ভূত শিল্পীরা, যারা ইউরোপ ও হলোকাস্ট নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন।”
সুপারম্যানকে কেন রণক্ষেত্রে পাঠানো হয়নি?
মজার ব্যাপার হলো, সুপারম্যানকে কখনও রণাঙ্গনে পাঠানো হয়নি। কিন্তু কেন? সুপারম্যান তো সব যুদ্ধ পাঁচ মিনিটে জিতে যেতে পারেন। তাহলে তাকে কেন পাঠানো হলো না রণাঙ্গনে?
ল্যারি টাই তার বই সুপারম্যান: দ্য হাই-ফ্লাইং হিস্ট্রি অফ আমেরিকা’স মোস্ট এন্ডিউরিং হিরো-তে বলেছেন, যদি সুপারম্যান যুদ্ধ জিতে যান, আর পরে যদি বাস্তবে সেনারা তা করতে না পারেন, তাহলে এটা এক ধরনের অসম্মান হবে। আর যদি না জেতেন, তবে সুপারম্যানের ক্ষমতার ওপরই প্রশ্ন উঠবে। এসব কারণেই সুপারম্যানকে সরাসরি রণাঙ্গনে পাঠানো হয়নি।
এই সমস্যার অবশ্য একটি সমাধান সামনে নিয়ে আসা হয়েছিল। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি পত্রিকার স্ট্রিপে দেখানো হয়—ক্লার্ক কেন্ট সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে গেছেন, কিন্তু এক্স রে ভিশন দিয়ে তিনি ভুল করে পাশের রুমের চার্ট পড়ে ফেলেছেন। ফলে তাকে সেনাবাহিনীর জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়!
যুদ্ধের পর সুপারম্যান
যুদ্ধ শেষ হলে, নতুন ভিলেন, নতুন চ্যালেঞ্জ আর নতুন প্রেক্ষাপটে ফিরে আসে সুপারম্যান। কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়টা রয়ে গেছে এক অনন্য অধ্যায় হিসেবেই।
সুপারম্যান অন দ্য কাউচ বইয়ের লেখক ড্যানি ফিঙ্গারথ বলেছেন, “সিগেল ও শাস্টার এমন এক চরিত্র তৈরি করেছিলেন, যার মধ্যে ছিল অ্যাকশন ও আবেগের নিখুঁত মিশেল, এবং যিনি সময়ের সাথে নিজেকে বদলাতে পারেন।”
অন্যদিকে হ্যারি ব্রড বলেছেন, “যুদ্ধ শুধু গুলি বা বোমা দিয়ে জেতা হয়নি, সুপারম্যানের মতো চরিত্রদের মাধ্যমে জনগণের মনোবল ধরে রাখাও ছিল বড় ধরনের এক কাজ।”
তথ্যসূত্র: হিস্ট্রি ডটকম
আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।