জীবনে সফলতার আগে ব্যর্থতা এসে হাজির হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তবে স্বপ্ন থাকলে ও লেগে থাকলে সব বাঁধা অতিক্রম করা সম্ভব। ক্যানভাকেই দেখুন। আজকে এটা ৪২ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যের প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের শুরুটা কিন্তু খুব একটা মসৃণ ছিল না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তারপর তাদের আসতে হয়েছে আজকের অবস্থানে। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে রিজেক্টেড হতে হয়েছে একশবারেরও বেশি!
আজ আপনাদের শোনাবো এই অনলাইন ডিজাইন প্ল্যাটফর্মের ঘটনাই। কীভাবে এক কিশোরীর মাথায় এলো এটি তৈরির চিন্তা, আর কীভাবে এটি হয়ে উঠলো সবার পরিচিত একটি নাম।
শুরুটা যেভাবে
২০০৬ সাল, অস্ট্রেলিয়া। ক্যানভার প্রতিষ্ঠাতা মেলানি পার্কিনসের বয়স তখন মাত্র ১৯। পার্থ শহরের এক ইউনিভার্সিটিতে তখন পড়ালেখা করছেন তিনি। অবসরে পার্টটাইম চাকরি করেন গ্রাফিক্স ডিজাইন ইন্সট্রাক্টর হিসেবে।
বাজারে তখনও গ্রাফিক্স ডিজাইনের সফটওয়্যার বলতে ছিল শুধু – মাইক্রোসফট ও অ্যাডোবির তৈরি করা সফটওয়্যারগুলো। মেলানি সেগুলো ব্যবহার করেই তার স্টুডেন্টদের শেখাতেন কীভাবে ডিজাইন করতে হয়। এটি করতে গিয়ে মোটাদাগে দুটি সমস্যা চোখে পড়লো তার।
এক. এই সফটওয়্যারগুলো বেশ দামী। কোনোটাই সস্তা না। এমনকি স্টুডেন্ট ভার্সন কিনতে গেলেও যে খরচ হয়, তা অনেকের পক্ষেই বহন করা সম্ভব না।
আর দুই. এই সফটওয়্যারগুলো কাজের হলেও, বেশ জটিল। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সফটওয়্যারের কোন জায়গায় কোন বাটন আছে এবং সেগুলো দিয়ে কী হয়, তা খুঁজতে ও বুঝতেই কোর্সের সেমিস্টার শেষ হয়ে যায় স্টুডেন্টদের।
এসব থেকে মেলানির মাথায় একটা চিন্তা এলো – যে – এরকম হলে কেমন হয়- এমন কোনো সফটওয়্যার থাকবে যা ব্যবহার করা খুব সহজ হবে এবং তা কাউকে কিনতে হবে না। একদম সহজ উপায়ে যে কেউ নিজের কাজ চালানোর মতো জিনিসটুকু বানিয়ে নিতে পারবে।
এখানে একটা জিনিস বলে রাখা ভালো – আমাদের দেশে এখনও দামী ডিজাইন সফটওয়্যারগুলোর ক্র্যাক ভার্সন বা পাইরেটেড ভার্সন পাওয়া যায়। অনেকেই নিরাপত্তার ঝুঁকি জেনেও তা ব্যবহার করেন। কিন্তু বাইরের দেশগুলোর হিসাব আগে থেকেই ভিন্ন। সেখানে অনেক সময় পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য মোটা অঙ্কের জরিমানা গুণতে হয়। ফলে অনেকেই চেষ্টা করে আসলটি কিনে ব্যবহার করার।
তো গল্পে ফেরত আসি। মেলানির মাথায় চিন্তা তো চলে এলো, কিন্তু সমস্যা ভিন্ন জায়গায়। তিনি কখনও কোনো ব্যবসা করেননি। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় জ্ঞানও তার নেই। মেলানি চিন্তা করলেন ঠেকতেই ঠেকতেই শিখবেন। তিনি হাত দিলেন তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে। প্রথমেই দলে ভেড়ালেন দীর্ঘদিনের বন্ধু ক্লিফ অব্রেখটকে। দুজনে মিলে পরিকল্পনায় নামলেন।
শুরুতেই এতো বড় কিছু করার আগে তারা ছোট কিছু তৈরি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না, সে সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখতে চাইল। জন্ম হলো ফিউশন বুকসের।
নতুন যাত্রা
মেলানি ও ক্লিফ ফিউশন বুকস শুরু করে ২০০৭ সালে। এটার আইডিয়াটা ছিল খুব সিম্পল। প্রতিটা স্কুলেই ইয়ারবুক ডিজাইন হতো। এই ডিজাইনের কাজগুলোকে তারা একটা ওয়েবসাইটে নিয়ে এলো।
আইডি পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করে দূর থেকে টিচার ও স্টুডেন্টরা নিজেদের ইয়ারবুকের ডিজাইনের কাজ খুব সহজে করতে পারবে এমনভাবে তৈরি করলো পুরো সাইটটাকে।
ডিজাইন হয়ে গেলে বই প্রিন্ট করার যে ঝামেলা, সেটিও তারা নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিলো। বিষয়টা অনেকটা হয়ে দাঁড়ালো এরকম – ডিজাইন আপনি করবেন, তারপর আমরা প্রিন্ট করে বই বানিয়ে আপনার কাছে পৌঁছে দিব।
বিষয়টাকে অনেক স্কুলই লুফে নিলো। দেখা গেলো তারা ফিউশন বুকস ব্যবহার করে নিজেদের ইয়ারবুক ডিজাইন করছে। আর তাদের ডিজাইনের কাজ হয়ে গেলে মেলানি ও ক্লিফ- সেগুলোকে প্রিন্ট করে বই আকারে বানিয়ে তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে এ প্রতিষ্ঠান জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করলো। মেলানির মায়ের বাসার বসার ঘর হয়ে উঠলো তাদের প্রথম অফিস।
আস্তে আস্তে অস্ট্রেলিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে নিউজিল্যান্ড ও ফ্রান্সেও ছড়িয়ে পড়লো ফিউশন বুকস। একপর্যায়ে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিলেন মেলানি। কারণ ব্যবসা এতো বড় হয়ে গেছে যে সেটিতে মনোযোগ দিতে হবে তার।
মজার ব্যাপার হলো, মেলানি ও ক্লিফ যদি সেখানে থেমে যেতেন, তাহলেও পারতেন। কারণ ততোদিনে তাদের ওই ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেছে, সেটার পেছনে বিনিয়োগ ভালো আসছে। এমনকি আয়ও ভালোই হচ্ছে। কিন্তু তারা থামলেন না। কারণ তাদের আসল লক্ষ্য তো ভিন্ন।
মেলানির ভাষায়, তাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি ওয়েবপেইজ তৈরি করা যেখানে ডিজাইনের সব ধরনের টুলস থাকবে এবং তা তারা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারবে।
শুরু হলো ক্যানভার দিকে তাদের যাত্রা।
মাঝপথে ধাক্কা
২০০৭ সালে ফিউশন বুকস প্রতিষ্ঠার পর পার হয়ে গেছে তিন বছর। তখন ২০১০ সাল। ক্যানভার পরিকল্পনা গুছাতে শুরু করলেন মেলানি ও ক্লিফ। অনলাইন সেবা ব্যবহার করে যে মানুষ ডিজাইন করতে আগ্রহী, সেটি তো তারা ফিউশন বুকসের মাধ্যমে এরই মধ্যে প্রমাণ করেছে। এমনকি এটাও স্পষ্ট যে যে এটির একটি মার্কেট রয়েছে। এখন তাদের প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ যা তাদেরকে তাদের ওই কাঙ্ক্ষিত অনলাইন সাইটটা বানাতে দেয়।
মুখে বলা সহজ হলেও, ওই ধরনের একটি সাইট তৈরি করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ও ব্যায়বহুল। আর মেলানি এবার আর শুধু নিজেদের ইয়ারবুক ধরনের ডিজাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছিলেন না। তিনি চাইছিলেন এমন কিছু তৈরি করতে যা দিয়ে বিজনেস কার্ড, পোস্টার – সব কিছুই তৈরি করা যাবে।
সমস্যা হলো, একের পর এক ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টের সঙ্গে মিটিং করলেও তাদের আগ্রহী করে তুলতে পারছিলেন না মেলানি। কোথায় যেন ব্যাটে বলে মিলছিল না।
কেন জানি নিজেদের পারফেক্ট অনলাইন ডিজাইন প্ল্যাটফর্মের আইডিয়াটা ঠিকভাবে সেল করতে পারছিলেন না তারা। একজন দুইজন, তিনজন করে একশরও বেশি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে মিটিং করলেন তারা। কিন্তু রাজি হলেন না একজনও।
কোথায় সমস্যা? ভাবতে বসলেন মেলানি। হঠাৎই পুরো বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেলো তার সামনে। আরে হ্যাঁ, তাইতো – এভাবে তো তাদের সামনে তুলে ধরা হয়নি কিছু। যেটা হয়েছিল – মেলানি ও ক্লিফ নিজেদের বিজনেস পিচ সুন্দরভাবেই তৈরি করেছিলেন। ক্যানভা কী, এটি কী কাজে আসবে, মার্কেটে কাদের উপকার করতে পারবে – সবই ছিল। যেটি ছিল না- সেটি হলো তার গল্প। কেন তিনি এরকম একটি সাইট তৈরি করতে চাইছেন সে বিষয়টা ছিল না।
তিনি এবার বিজনেস পিচে নিজের গল্পটাও যোগ করলেন। তুলে ধরলেন কীভাবে স্টুডেন্টদের সেমিস্টার পার হয়ে যায় বাজারের দামী সফটওয়্যারের বাটন সম্পর্কে জানতে জানতেই। সেগুলো দেখার পর কীভাবে সহজ সেবা তৈরির কথা তার মাথায় এলো, সেটিও তুলে ধরলেন। এবার নড়েচড়ে বসলো বিনিয়োগকারীরা।
কারণ গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় কোনো অজানা অচেনা বা অল্প জানা সফটওয়্যার ব্যবহার করতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়া, বারবার হোঁচট খাওয়া – এগুলো সবারই হয়। বিনিয়োগকারীরাও এর ব্যতিক্রম নন। তারা মূল সমস্যাটার সঙ্গে কানেক্ট করতে পারলেন। পিচটা যান্ত্রিক থেকে হয়ে উঠলো মানবিক।
আরেকটা জিনিস হলো এর মধ্য দিয়ে। স্টার্টআপের মূল একটি বৈশিষ্ট্য হলো – সেগুলো কোনো না কোনো বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। যতো বড় সমস্যা, ততো বেশি দাম সেটার। মেলানি নিজের অভিজ্ঞতার গল্প যোগ করার কারণে – বিশ্বে বিদ্যমান বড় একটা সমস্যা চোখের সামনে চলে এলো সবার। তারা দেখলো- মেলানি ও ক্লিফ এমন একটি সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন, যা নিয়ে আর কেউ তখন কাজ করছে না।
মেলানি প্রথম বড় ব্রেক পেলেন। সিলিকন ভ্যালির বিনিয়োগকারী বিল টাইয়ের পছন্দ হয়ে গেলো মেলানির পরিকল্পনা।
অদ্ভুত বিল!
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মেলানির পরিকল্পনা যে বিলের পছন্দ হয়েছে, তা তার আচরণ দেখে বুঝার উপায় ছিল না। বিলের কাছে নিজেদের পিচ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ফ্র্যান্সিসকোতে গিয়েছিলেন। সেখানে এক রেস্টুরেন্টে বিলকে পুরো আইডিয়া শোনাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু বিল ব্যস্ত ছিলেন ফোনে। ফলে মেলানির মনে হচ্ছিল, বিল বোধহয় ঠিক তার আইডিয়াটিা পছন্দ করছেন না। আসলে বিল তখন ফোনে নিজের নেটওয়ার্কের আর কার সঙ্গে সঙ্গে মেলানির পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়, তা খুঁজছিলেন।
যা-ই হোক এরপর বিল তাকে পরিচয় করিয়ে দেন কয়েকজনের সঙ্গে। অন্যদের সঙ্গে পরিচিত হতে এবং ব্যবসার স্বার্থে সম্পূর্ণ নতুন একটা খেলা পর্যন্ত শিখতে হয়েছিল মেলানিকে। বিল ছিলেন কাইটসার্ফার। তার পরিচিত বিনিয়োগকারীরাও ছিলেন তাই। মেলানিকেও বাধ্য হয়ে তাই কাইটসার্ফিং শিখতে হয়েছিল, যাতে তিনি বিলের ওই নেটওয়ার্কের কাছাকাছি যেতে পারেন, তাদের কাছ থেকেও সহায়তা পেতে পারেন। এ ব্যাপারে বিলই তাকে উৎসাহিত করেছিল।
ধীরে ধীরে মেলানির দল বড় হতে থাকা। প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে তিনি দলে পান গুগল ম্যাপসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা লার্স রাসমুসেনকে। পরে এতে ডেভেলপার হিসেবে যোগ দেন আরেক দক্ষ প্রযুক্তিবিদ ডেভ হার্নডেন। এতে যুক্ত হন গুগলের সাবেক নির্বাহী ক্যামেরন অ্যাডামসও।
এবার ঘুরতে শুরু করে ক্যানভার চাকা। ২০১২ সাল নাগাদ কাঠামো দাঁড়িয়ে যায় ক্যানভার। আর ২০১৩ সালে এটি লঞ্চ করা হয় সবার জন্য।
পরিশেষে
বিশ্বের ১৯০টি দেশের দুইশ কোটিরও বেশি ডিজাইনার একবার হলেও ক্যানভা ব্যবহার করেছেন। সংখ্যাটা চমকে উঠার মতোই। তবে মেলানি ও ক্লিফের জন্য এটিও যথেষ্ট না। তারা চেষ্টা করছেন এটিকে আরও বড় করতে। ও হ্যাঁ বলে রাখি, ক্লিফ ও মেলানি কিন্তু এখন স্বামী-স্ত্রী, আবার বিজনেস পার্টনারও!
যে ক্যানভার জন্য একসময় বিনিয়োগকারী পেতে সমস্যা হচ্ছিল, এখন সে ক্যানভার সাপোর্টে রয়েছেন হলিউডের ওয়েন উইলসন, উডি হ্যারেলসনের মতো তারকারা। আসলে এসব হয়েছে থেমে না যাওয়ার কারণে, সে সময় যদি মেলানি থেমে যেতেন বা নিজেদের পুরোনো ব্যবসায় ফেরত যেতেন, তাহলে আজ আর হয়তো আমরা ক্যানভা পেতাম না। আর তাদেরও লক্ষ্য পূরণ হতো না।








