১৯৬৬ সালের মে মাস। দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যজগতে তখন রোমাঞ্চ ও অ্যাডভেঞ্চারের বড় অভাব। ঠিক তখনই ‘সেবা প্রকাশনী’র হাত ধরে এক নতুন নায়ক হাজির হলেন পাঠকের সামনে। নাম মাসুদ রানা।
প্রথম বই ‘ধংস-পাহাড়’-এর মাধ্যমে মাসুদ রানার হাত ধরে বাঙালি পাঠক পৌঁছে গেলেন স্পাইয়ের দুনিয়ায়। এক নতুন জগত খুলে দিলো তাদের সামনে। সেই থেকে শুরু, এ পর্যন্ত মাসুদ রানার বই এসেছে পাঁচশরও বেশি।
এমন একটা সময় ছিল যখন ছেলেবুড়ো টানা পড়ে গেছেন মাসুদ রানা। মাসের পর মাস এটির অপেক্ষায় থেকেছেন। অনেক বাসায় এটি নিষিদ্ধ বই হিসেবে গণ্য হতো। কেউ উচ্চ মাধ্যমিকের আগে এ বই পড়ে ফেললে তাকে তিরস্কারও সহ্য করতে হতো। এর পেছনে আসলে কারণও ছিল। রানা যে শুধু স্পাই দুনিয়াকে সামনে নিয়ে এসেছিল তা নয়, এর প্রথমদিকের বইগুলোতে যৌনতার উপস্থিতিও ছিল। একেবারে রগরগে না হলেও মোটাদাগে রক্ষণশীল মানসিকতার বাঙালি সমাজের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য সেটুকুই ছিল যথেষ্ট।
এর একটা কারণ হতে পারে যে বইগুলোর বেশির ভাগই বিদেশি কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে লেখা হতো এবং খোদ মাসুদ রানাই ছিল জেমস বন্ডের অনুপ্রেরণায় সৃষ্টি করা চরিত্র। তবে একেবারে প্রথম বই দুটি ছিল এর স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা মৌলিক কাহিনী। সেগুলোতে বিদেশি গল্পের কোনো ছোঁয়া নেই। বরং ছিল দীর্ঘ প্রস্তুতি। মাসুদ রানার প্রথম বইটার পাণ্ডুলিপি তৈরি হতে সময় লেগেছিল সাত মাস!
যার নাম না বললেই না
মাসুদ রানা তৈরি হওয়ার বা এটি লেখার সিদ্ধান্তে আসার ঘটনাটা বেশ মজার। তখন ১৯৬৫ সাল। কাজী আনোয়ার হোসেন ব্যস্ত কুয়াশা সিরিজ নিয়ে। একদিন কাজী আনোয়ার হোসেনের এক বন্ধু মাহবুব আমিন কুয়াশা সিরিজের কয়টা বই নিলেন তার কাছ থেকে। কিন্তু বই পড়ে বলা চলে কাজী আনোয়ার হোসেনকে একরকম মৃদু তিরস্কারই করলেন তিনি। কারণ মাহবুব আমিন কুয়াশা পড়তে গিয়ে অনুভব করেছিলেন যে বিশ্বের থ্রিলার যে পর্যায়ে চলে গেছে, সেদিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে কুয়াশার লেখনী।
মাহবুব আমিন কাজী আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে গেলেন বইয়ের দোকানে। তাকে ইয়ান ফ্লেমিংয়ের লেখা ‘ড. নো’ বইটা কিনে উপহার দিলেন। বইটা পড়তে গিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন সত্যিকার অর্থেই পিছিয়ে থাকার বিষয়টা অনুভব করলেন।
এর পরের কয়েক মাস কাজী আনোয়ার হোসেন হাতের কাছে যতো থ্রিলার সাহিত্য পেলেন, তা পড়ে ফেললেন। আর এসবের মধ্যে দেশের পটভূমিতে স্পাই চরিত্র গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন তিনি। জন্ম হলো মাসুদ রানার।
মোটরসাইকেলে চট্টগ্রাম, কাপ্তাই, রাঙামাটি
মাসুদ রানার প্রথম বইটা লেখার সময় দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। একদিকে সমসাময়িক বিদেশি থ্রিলার পড়ার পর সেগুলোর কাঠামো সম্পর্কে ভালো একটা আইডিয়া হয়ে গিয়েছিল তার।
অন্যদিকে যেহেতু এটি দেশীয় পটভূমিতে রচিত হচ্ছে, সেহেতু সেদিকেও বিশাল প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। চলে গিয়েছিলেন পার্বত্য অঞ্চলে। সরেজমিনে মোটরসাইকেলে করে ঘুরে দেখেছিলেন চট্টগ্রাম, কাপ্তাই ও রাঙামাটি। এর পর হাত দিয়েছিলেন লেখার কাজে।
পাণ্ডুলিপি তৈরির পর কাজী আনোয়ার হোসেন আবারও ফিরে গেলেন বন্ধু মাহবুব আমিনের কাছে। তাকে পড়তে দিলেন খসড়াটা। পাশাপাশি আরেক বন্ধু আতাউল হকের সহায়তা নিলেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা। তার কাছ থেকেও পরামর্শ নিলেন। এভাবে সাত মাস ব্যয় করে তিনি গুছিয়ে তুললেন মাসুদ রানার প্রথম বই।
কাজী আনোয়ার হোসেন একবার সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছিলেন, আমি যা হতে পারিনি, তা-ই মাসুদ রানা।
বিদেশি গল্পের ছোঁয়া
মাসুদ রানার প্রথম দিকের কয়েকটা বইয়ের পরে এর ওপর প্রবলভাবেই দেখা যেতে থাকে বিদেশি থ্রিলারের ছোঁয়া। তবে গল্প বলার কৌশলটি সবসময় ছিল – সহজ ও সাবলীল। পাঠক যেন নিজের চোখে দেখতে পেতেন কী কী ঘটছে।
কাজী আনোয়ার হোসেন রানা চরিত্রে যুক্ত করেছিলেন বাংলা সংস্কৃতির নিজস্বতা। রানার পোশাক, কথাবার্তা, এমনকি তার প্রেমভঙ্গিমাতেও ছিল ঢাকার তরুণ সমাজের প্রতিচ্ছবি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব ছিল সর্বত্র। স্বাভাবিকভাবেই সে প্রভাব এসে পড়েছিল মাসুদ রানার ওপরেও।
স্বাধীনতার পরে মাসুদ রানার যে বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো পড়লে স্পষ্ট হয়ে যায় যে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে রানারও ভূমিকা রয়েছে। সেও ছিল মাঠে।
এ ছাড়াও পরের গল্পগুলোতে দেশীয় রাজনীতি, দেশপ্রেম, ৭১-পরবর্তী ষড়যন্ত্রের ছাপ ইত্যাদি যোগ হয়েছিল। রানা সে সময় প্রকৃত অর্থে হয়ে উঠেন বাংলাদেশি স্পাই, যে কেবল বিদেশ নয়, দেশের ভেতরের দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও লড়ছে।
গোপন লেখক, কপিরাইট যুদ্ধ
প্রথমদিকে কাজী আনোয়ার হোসেন মাসুদ রানার বইগুলো লিখলেও, পরে ঘোস্ট রাইটাররা এর সঙ্গে যুক্ত হন। সম্পাদনার কাজ অবশ্য কাজী আনোয়ার হোসেনই করতেন।
এরকম ঘোস্ট রাইটারের মধ্যে শেখ আবদুল হাকিম ছিলেন অন্যতম। তিনি পরবর্তীতে রানার শত শত বই লিখেছেন। এমনকি সেবা প্রকাশনীর আরেক বিখ্যাত লেখক – রকিব হাসানের শুরুটাও এ ধরনের লেখার মাধ্যমে হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে রকিব হাসান সেবার অফিসে গিয়েছিলেন মাসুদ রানার জন্য ১২টা প্লট নিয়ে, তা-ও আবার শেখ আবদুল হাকিমের অনুরোধে।
শুরুতে বিষয়গুলো নিয়ে সমস্যা না হলেও পরে ব্যাপক আইনি জটিলতা দেখা দেয়। ২০১০ সালে প্রথম কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেন শেখ আবদুল হাকিম।
তার কথা ছিল, তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া বইগুলো বিক্রি করে সেবা বছরের পর বছর অর্থ আয় করলেও, তিনি সেখান থেকে কিছুই পাচ্ছেন না।
সমস্যা যেখানে
শেখ আবদুল হাকিম দুটি কারণে বই লিখেও কখনও নিজের নাম দিতে চাননি বা এ নিয়ে আপত্তি তুলেননি।
এক. বইগুলোর কাহিনী ইংরেজি সাহিত্য থেকে নেওয়া হতো, ফলে তার কাছে তা নকল মনে হতো এবং তিনি এর সঙ্গে সরাসরি নিজের নাম জড়াতে চাইতেন না।
দুই. বইয়ে কাজী আনোয়ার হোসেনের নাম থাকলে তা বিক্রি বেশি হতো।
আসলে নাম দেওয়া বা না দেওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা কখনই ছিল না। সমস্যা ছিল বাড়তি পারিশ্রমিক নিয়ে। শুরুতে এককালীন পাঁচশ টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বই লেখা শুরু করেছিলেন শেখ আবদুল হাকিম। পরবর্তীতে তা বেড়ে দশ হাজার টাকা হয়েছিল। কিন্তু এই অর্থ শুধু একবারই পেতেন তিনি।
যেহেতু মাসুদ রানা ব্যাপক জনপ্রিয় ও এর চাহিদা রয়েছে, সেহেতু মাসুদ রানার বইগুলো বারবার রিপ্রিন্ট করতে হতো সেবা প্রকাশনীকে। আর প্রতিবারই সেবার আয় হতো। কিন্তু রিপ্রিন্টের ক্ষেত্রে লেখক হিসেবে আর কোনো বাড়তি অর্থ শেখ আবদুল হাকিমকে দেওয়া হত না। ফলে শেখ আবদুল হাকিম বঞ্চিত হয়েছেন বলে মনে করতেন। অন্যদিকে কাজী আনোয়ার হোসেনের কথা ছিল, টাকা তো দেওয়া হয়েছে লেখার সময়।
তো ২০১০ সালে তোলা অভিযোগের সুরাহা না হওয়ায় ২০২০ সালে এসে কপিরাইট অফিসে কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে মামলা ঠুকে দেন শেখ আবদুল হাকিম। তিনি মাসুদ রানার ২৬০টি ও কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের স্বত্ত্ব চান।
কপিরাইট অফিসের সে মামলা গিয়ে ঠেকে উচ্চ আদালতে। কারণ কপিরাইট অফিস মোট ৩৬০টি বইয়ের স্বত্ত্ব শেখ আবদুল হাকিমকে দিয়ে দিয়েছিল। তবে দিনশেষে উচ্চ আদালতেও বিষয়টির স্পষ্ট সুরাহা হয়নি। এদিকে মামলা চলাকালেই মারা যান শেখ আবদুল হাকিম ও কাজী আনোয়ার হোসেন। ফলে এখনও একরকম ধোঁয়াশাই রয়ে গেছে স্বত্ত্বের ইস্যুটি।
রূপালি পর্দায় রানা: বই থেকে বড়পর্দার অভিযান
মাসুদ রানা দুই বার হাজির হয়েছে রূপালী পর্দায় এবং দুইবারই ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল দর্শকদের মধ্যে।
প্রথম ১৯৭৪ সালে চলচ্চিত্র জগতের অভিনেতা সোহেল রানা নিজেই রানা হয়ে হাজির হন বড়পর্দায়। সেটির নামই ছিল মাসুদ রানা। তুমুল সাড়া ফেলে ছবিটি। তবে তখন প্রযুক্তিগত অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। ফলে সিনেমাটি হয়ে উঠেছিল গল্পনির্ভর।
এর অনেক বছর পরে ২০২৩ সালে মুক্তি পায় এমআর-৯: ডু অর ডাই, যা ছিল মাসুদ রানার আধুনিক রূপ। এখানে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন এবিএম সুমন। এই ছবি দুই বাংলার দর্শকের কাছে রানা চরিত্রকে নতুন করে আবারও পরিচিত করায়। বড় বাজেটে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নির্মাণ ছিল সিনেমাটি।
শেষকথা
১৯৮০-৯০ এর দশকে স্কুল-কলেজের তরুণদের জন্য মাসুদ রানা হয়ে উঠেছিল সাহস, বুদ্ধি, দুঃসাহসের প্রতীক। অনেকেই রানা পড়ে বড় হয়েছেন, রানা পড়ে স্বপ্ন দেখতে শিখেছেন।
তখন মোবাইল, ইন্টারনেট ছিল না। রানা ছিল তখনকার অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য, প্রেম আর দেশপ্রেমের একমাত্র প্ল্যাটফর্ম।
রানাকে ঘিরে এক পাঠক বলেছিলেন,“যখন হতাশ হতাম, তখন একটা রানা পড়েই মনে হতো আমি পারবো!”
মাসুদ রানার স্বার্থকতা আসলে বহু দিকে। এটি একদিকে যেমন বহু মানুষের মনের খোরাক যুগিয়েছে, ঠিক সেভাবেই বাংলাসাহিত্যে যারা পশ্চিমা চরিত্রের ছায়া খুঁজতেন, তাদেরকেও আঁকড়ে ধরার মতো কিছু দিয়েছে।
যুগ বদলেছে, পাঠক বদলেছে, প্লটও বদলেছে। কিন্তু রানার পরিচয় রয়ে গেছে একই। রানার পরিচয়? বীরত্ব, দেশপ্রেম আর অবিশ্বাস্য সাহস।
উইজ বাল্বের জন্য লেখাটি লিখেছেন: রাজা জহুর খান
আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।








