ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি ছবি গোটা দুনিয়ার বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছিল। তাকে উঠে এসেছিল এক ভীতিকর মুহূর্ত, এক শিশুর আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি। ছবির নাম: ‘The Terror of War’, তবে বিশ্ব তাকে চেনে ‘Napalm Girl’ নামে।
১৯৭৩ সালে World Press Photo এই ছবিটিকে বর্ষসেরা পুরস্কার দেয়। পরের বছরই এটি পুলিৎজার পুরস্কার জিতে নেয়। এতদিন ধরে সবাই জানত, এই ছবির আলোকচিত্রী নিক উট (Nick Ut), তিনি সে সময় ভিয়েতনামে নিযুক্ত Associated Press (AP)-এর ফটোগ্রাফার।
কিন্তু ৫০ বছর পর এই ইতিহাস নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠেছে। ‘The Stringer’ নামের একটি ডকুমেন্টারিতে দাবি করা হয়েছে—ছবিটি উট নয়, বরং নগুয়েন থানে (Nguyen Thanh Nghe) নামের একজন ভিয়েতনামিজ ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী তুলেছিলেন। অন্তত তথ্যপ্রমাণ সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। ডকুমেন্টারিটি এ বছরের জানুয়ারিতে Sundance Film Festival-এ প্রদর্শিত হয়।
এর পরপরই World Press Photo একটি বড় সিদ্ধান্ত নেয়—তারা এই ছবির আলোকচিত্রী হিসেবে নিক উটের নাম ‘সাময়িকভাবে স্থগিত’ করে।
তাহলে কে তুললেন সেই ছবি?
ঘটনা ১৯৭২ সালের ৮ জুন। ভিয়েতনামের ট্র্যাং ব্যাং নামক গ্রামে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দক্ষিণ ভিয়েতনামী বিমানবাহিনী ভুল করে বোমা ফেলে দেয়। তারা ভেবেছিল সেখানে শত্রু লুকিয়ে আছে। সেই আগুন থেকে দৌড়ে পালাতে দেখা যায় এক শিশুকে। নাম ফান থি কিম ফুক (Phan Thi Kim Phuc)। ওই শিশুর বয়স তখন মাত্র ৯।
ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেলা সেই মুহূর্তটি কে ফ্রেমে তুললেন এ নিয়েই এখন দ্বিধা। World Press Photo এক বিশদ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, “ভিজ্যুয়াল ও টেকনিক্যাল” তথ্য বলছে, নগুয়ান থানেরই এটি তোলার সম্ভাবনা বেশি। তবে তারা স্পষ্ট করেছে, নতুন করে কারও নাম লেখার মতো পর্যাপ্ত প্রমাণও নেই হাতে। ফলে বর্তমানে আলোকচিত্রী হিসেবে কারো নাম লেখা স্থগিত রেখেছে তারা।
ডকুমেন্টারির দাবি কী?
“The Stringer” ডকুমেন্টারিতে বলা হয়, থানে মূল ছবিটি তুলে পরে সেটা এপিকে বিক্রি করেছেন- এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরে তৎকালীন এপির সম্পাদকরা উটকে সেই ছবির কৃতিত্ব দিয়ে দেন, কারণ ওই সময় উট এপির হয়ে ভিয়েতনামে কাজ করছিলেন।
উট অবশ্য বরাবরই এ ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার আইনজীবীর মাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তিনি বলেন, “এই অভিযোগের পক্ষে একটিও প্রমাণ বা প্রত্যক্ষদর্শী নেই। এটি হতাশাজনক ও অপেশাদার আচরণ।”
এপি কী বলছে?
সম্প্রতি এপি নিজেরাই ৯৬ পৃষ্ঠার বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
তাদের তদন্তে-
- ঘটনাস্থলের থ্রিডি মডেল ও নেগেটিভ পরীক্ষা করা হয়।
- উটের ব্যবহৃত ক্যামেরা, অবস্থান ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করা হয়।
এপির বক্তব্য হলো – এমন কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই যা বলছে উট নয়, অন্য কেউ ছবিটি তুলেছিলেন। তবে সময়ের ব্যবধান, সাক্ষ্যপ্রমাণের ঘাটতি থাকায় পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়াও সম্ভব হচ্ছে না।
তাদের কথায়, নগুয়ান থানের এর নাম দেওয়ার জন্য বিশ্বাসের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি শূণ্যস্থান পূরণ করতে হবে। ফলে তারা ছবির আলোকচিত্রী হিসেবে উটের নামই রাখছে।
World Press Photo-এর পাল্টা যুক্তি
অন্যদিকে World Press Photo তাদের বিবৃতিতে জানায়, “সন্দেহের মাত্রা এতটাই গুরুতর যে, আমরা আগের অ্যাট্রিবিউশন ধরে রাখতে পারছি না।”
তবে কারো নাম নতুন করে লেখার মতো প্রমাণ না থাকায় এই স্থগিতাদেশই আপাতত থাকবে।
তারা তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে প্রশ্ন তোলে:
- ক্যামেরা: এপি একসময় বলেছিল ছবিটি Pentax ক্যামেরায় তোলা, যা থানে ব্যবহার করতেন। উট বলেছিলেন তিনি Leica ও Nikon ব্যবহার করতেন।
- অবস্থান: একটি প্যারিস-ভিত্তিক গবেষণা গোষ্ঠী Index দাবি করে, উট যদি ছবি তুলে থাকেন, তবে তাকে ৬০ মিটার দৌড়ে গিয়ে পরে ফিরে আসতে হতো—যা সময় অনুযায়ী “অত্যন্ত অসম্ভব, যদিও একেবারে অসম্ভব নয়।”
- তৃতীয় ব্যক্তি: এমনকি World Press Photo জানায়, ভিয়েতনামী সেনাবাহিনীর এক আলোকচিত্রী Huynh Cong Phuc এরও ছবিটি তোলার সম্ভাবনা আছে। তিনি মাঝেমধ্যে সংবাদ সংস্থাকে ছবি বিক্রি করতেন।
এপি অবশ্য এখনও উটের পক্ষে নানা ধরনের যুক্তি দিয়ে যাচ্ছে। যেমন- তারা জানিয়েছে, উটেরও একটা পেনটাক্স ক্যামেরা ছিল, সেটির কিছু নেগেটিভও আছে তাদের হাতে। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে উটের দূরত্ব ছিল মাত্র ৩২ দশমিক আট মিটার। ফলে সেটি পাড়ি দেওয়া তার জন্য অসম্ভব কিছু না।
উটের বক্তব্য
এই মাসের শুরুর দিকে এপির প্রতিবেদনে স্বস্তি প্রকাশ করে নিক উট বলেন, “এতে প্রমাণিত হয়েছে যা আমরা এতদিন ধরে জানতাম—ছবিটির কৃতিত্ব আমারই।” তিনি জানান, “এই পুরো বিষয়টি আমাকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছে।”
ছবিটি তোলার মুহূর্ত নিয়ে তিনি বলেন, “আমি কিম ফুক-কে দৌড়াতে দেখি, সে চিৎকার করছিল—‘খুব গরম! খুব গরম!’। আমি দেখলাম তার শরীর ঝলসে গেছে। সঙ্গে সঙ্গেই ক্যামেরা ফেলে তাকে সাহায্য করতে যাই।”
উট বলেন, আহত শিশুদের তিনি নিজেই তাঁর ভ্যানে তুলে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যান—যাত্রায় সময় লাগে ৩০ মিনিট।
প্রতীকের শক্তি
ছবিটি প্রকাশিত হয় পরদিনই বিশ্বের সব নামী দৈনিকে। এটি হয়ে ওঠে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক।
কিম ফুক বেঁচে যান, পরে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় পান। এরপর তিনি ও উট দু’জনেই বিশ্বজুড়ে শান্তি ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেছেন।
পুলিৎজার পুরস্কার কী বলছে?
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে পাঠানো এক বিবৃতিতে Pulitzer Prize কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা পুরস্কার পুনর্বিবেচনার কোনো সম্ভাবনা দেখছে না। তাদের মতে, “সংবাদ সংস্থার দায়ই হলো ছবির স্বত্ত্বাধিকারী নির্ধারণ করা। এপির তদন্তে স্বত্ব তুলে নেওয়ার মতো প্রমাণ মেলেনি।”
ফলে এখনও এক দিক থেকে ছবিটির সঙ্গে নিক উটের নাম জুড়ে রয়েছে। তবে যে বিতর্ক উঠেছে, তা পুরো বিশ্বেই জন্ম দিয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনার।
তথ্যসূত্র: সিএনএন
আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।