ভূতের বোর্ড

ভূতের বোর্ড না নিছক খেলা? ১৩০ বছরের রহস্যময় যাত্রা ওউইজার

ভূতের ডাক, অশরীরী আত্মার বার্তা, কিংবা অজানা কোনো অলৌকিক উপস্থিতি—আজ ‘ওউইজা বোর্ড’-এর নাম শুনলে আমাদের মনে এইসব দৃশ্যই ভেসে ওঠে। কিন্তু প্রায় ১৩৫ বছর আগে, এটি ছিল শুধুই একধরনের পার্লার গেম, ঘরোয়া বিনোদনের মাধ্যম। ভিক্টোরিয়ান আমলে এই বোর্ড ছিল আড্ডার আনন্দময় অনুষঙ্গ, কোনো ভয়ের উপাদান নয়।

১৮৯০ সালে এটি প্রথম বাজারে আসে আমেরিকার কেনার্ড নভেলটি কোম্পানির হাত ধরে। তখন একে বলা হতো “wonderful talking board” বা বিস্ময়কর এক বোর্ড যা কথা বলতে পারে।

এটি ছিল সাধারণ এক টুকরো কার্ডবোর্ড, যার উপর ইংরেজি অক্ষর, সংখ্যা, এবং “yes,” “no,” ও “goodbye” লেখা থাকত। খেলোয়াড়েরা একটি ত্রিভুজাকৃতি ‘প্ল্যানচেট’-এর উপর আঙুল রাখত, আর সেটা বোর্ডের উপর ঘুরে ঘুরে প্রশ্নের উত্তরে শব্দ গঠন করত।

এক খেলার জন্ম, অন্য এক আবেগেরও

ওউইজা বোর্ড নতুন হলেও, এর ধারণা কিন্তু বেশ পুরোনো। ১৮৪০-এর দশকে Modern Spiritualist Movement জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষ তখন আত্মার সঙ্গে যোগাযোগকে একধরনের সামাজিক বিনোদন হিসেবে নিত। সে সময় সেয়ান্স, ট্যারট কার্ড, এবং এমন বোর্ডের মাধ্যমে আত্মার বার্তা পাওয়া ছিল একধরনের ট্রেন্ড।

সে ধারণাকেই বোর্ডের মাধ্যমে নিয়ে আসার প্রয়াস ছিল ওউইজা। শুরুতে মানুষ খুব একটা আমলেও নেয়নি। নিছক বিনোদন হিসেবেই নিয়েছিল।

ডেনভারের মলি ব্রাউন হাউজ মিউজিয়ামের-এর কিউরেটর স্টেফানি ম্যাকগোয়ার বলেন, “আজ ওউইজা বোর্ডকে যেভাবে ভয় ও অশুভতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, তখন তা ছিল এক বিস্ময়ের বস্তু। মানুষ ভাবত, আমি কি সত্যিই অজানার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারি? ভবিষ্যৎ জানতে পারি?”

এই যে এ ধরনের চিন্তাভাবনা। এর সঙ্গে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের একটা সম্পর্ক ছিল। তখনকার মানুষ মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছিল। ফলে এটি তারা অনুভব করত। গৃহযুদ্ধের পর আমেরিকায় বহু পরিবারই হঠাৎ প্রিয়জন হারানোর শোক বয়ে বেড়াত। আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ বা অন্তত সে চেষ্টাটি ছিল একধরনের মানসিক সান্ত্বনা।

ওউইজা গবেষক ও টকিং বোর্ড হিস্টোরিকাল সোসাইটির চেয়ারম্যান রবার্ট মার্চ বলেন, “আজ আমরা মৃত্যুর থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। আমরা চাই দীর্ঘজীবন, চিরযৌবন, এমনকি বৃদ্ধতাও যেন দূরে থাকে। অথচ অতীতে মানুষ মৃত্যুকে জীবনচক্রের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে গ্রহণ করত।”

তার মতে, তখন এই বোর্ড ছিল একধরনের সহানুভূতির মাধ্যম, যা মানুষকে এমন কিছুর সঙ্গে সংযুক্ত করত, যেটা তারা বোঝে না, কিন্তু অনুভব করতে চায়।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণাগুলো ফিকে হতে শুরু করে। মৃত্যু আবারও চলে যায় মানুষের মনোযোগের আড়ালে।

যুদ্ধের পর প্রেম ও ওউইজা একসঙ্গে

বিশ্বযুদ্ধ ও ১৯১৮ সালের ফ্লু মহামারির পরে আবারও ফিরে আসে স্পিরিচুয়ালিজম। অনেকে আবার এটিকে ভবিষ্যত জানার জন্যও ব্যবহার করতে শুরু করে। এ কারণেই হয়তো ১৯২০-এর দশকে ওউইজা বোর্ড হয়ে ওঠে অনেক প্রেমিক-প্রেমিকার একটি রোমান্টিক খেলা। তারা পাশাপাশি বসে বোর্ডে প্রশ্ন করত—“আমার ভবিষ্যতের সঙ্গী কে?”

এ নিয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নরম্যান রকওয়েলের আঁকা ছবিও রয়েছে। ১৯২০ সালের Saturday Evening Post-এ তাঁর আঁকা এক প্রচ্ছদে দেখা যায় এক তরুণ-তরুণী হাঁটুর কাছে হাঁটু ছুঁইয়ে বসে, বোর্ডের উপর আঙুল রেখে খেলছে—বোর্ডটি যেন তাদের ভালোবাসার মাধ্যম।

যেখানে ভয়ের শুরু

তবে ওউইজা বোর্ডের এই নিরীহ রূপ পাল্টাতে শুরু করে ষাটের দশকের শেষভাগ থেকে। একেবারে বোর্ডের ভাবমূর্তিই বদলে যেতে থাকে। আমেরিকার সমাজে তখন ঘটছে নানা চাঞ্চল্যকর ঘটনা—ম্যানসনের হত্যাকাণ্ড, চার্চ অব স্যাটান-এর উত্থান। এসবের প্রভাব বোর্ডের গায়েও লাগতে শুরু করে।

মজার ব্যাপার হলো, নিষিদ্ধ ও রহস্যময় জিনিসের প্রতি মানুষের যে আকর্ষণ তা আরও একবার প্রমাণিত হয়। ১৯৬৭ সালে ওউইজা বোর্ড বিক্রিতে Monopoly-কেও ছাড়িয়ে যায়—২০ লাখেরও বেশি বোর্ড বিক্রি হয়। এখন পর্যন্ত আর কোনো বোর্ড গেম এভাবে মনোপলিকে বিক্রিতে টেক্কা দিতে পারেনি। শুধু ওউইজাই পেরেছে।

তবে পাকাপোক্তভাবে মোড় ঘুরিয়ে দেয় ১৯৭৩ সালের সিনেমা The Exorcist। সেখানে একটি শিশু একা ওউইজা বোর্ড নিয়ে খেলে, পরে সে শয়তানের কবলে পড়ে। এটাই ছিল প্রথম সিনেমা যেখানে ওউইজা বোর্ডের মাধ্যমে আত্মা ঢোকার গল্প দেখানো হয়।

সালেম উইচ বোর্ড মিউজিয়ামএর মালিক জন কোজিক বলেন, “যখন মানুষ দেখে কোনো ভীতিকর সিনেমা সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে, তখন তারা ভাবে, আমার সঙ্গেও এমনটা ঘটতে পারে।”

প্রথমটির পর ওউইজা বোর্ডকে কেন্দ্র করে তৈরি হতে থাকে একের পর এক হরর সিনেমা, যেমন Witchboard। এই সিনেমাগুলোর হাত ধরেই জন্ম নেয় বহু আজগুবি ধারণা—যা আজও টিকে আছে।

বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা, কিন্তু ভয় যায় না

বিজ্ঞান বলছে, আসলে ওউইজা বোর্ডে আঙুল নড়ার পেছনে রয়েছে ideomotor phenomenon নামের এক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। যেখানে মানুষ নিজের অজান্তেই হাত নাড়ায়—আত্মা বা ভূতের কোনো সংযোগ নয়।

তবুও ভয়টা থেকে যায়। আজও বহু মানুষ বোর্ড পুড়িয়ে ফেলেন, গির্জায় দিয়ে আসেন বা জাদুকর ডেকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দেন। জন কোজিক জানান, “অনেক মানুষ বোঝেন এটা বিজ্ঞানের ব্যাপার, তবুও বোর্ড রাখলে অস্বস্তি বোধ করেন।”

একটি বোর্ড, অনেক মানে

১৩০ বছরের ইতিহাসে ওউইজা বোর্ড শুধু একটি খেলাই নয়, হয়ে উঠেছে মানুষের কল্পনা, ভয় ও বিশ্বাসের এক ধরনের মিলনস্থল। একেক সময় একেক রূপ—কখনও প্রেমের উপকরণ, কখনও মানসিক সান্ত্বনা, কখনও বা আতঙ্কের প্রতীক।

এখনও পশ্চিমে হ্যালোইনের রাতে বা কিশোর-কিশোরীদের স্লিপওভারে এই বোর্ড ব্যবহার হয়। কেউ হয়তো মজা করে খেলে, আবার কেউ বিশ্বাস করে সত্যিই কিছু একটা ‘আছে’।

ওউইজা বোর্ড হয়তো নিছক এক টুকরো বোর্ড, কিন্তু তার উপর হাত রাখলে মানুষের মনে ওঠে জেগে হাজারো প্রশ্ন—আমরা কি একা? নাকি কোনো অজানা শক্তি সব সময় পাশে আছে?

তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।