ভেপের বিপদ

ভেপের বিপদ: ধোঁয়ার আড়ালে লুকানো স্বাস্থ্য সংকট

ভেপ যখন বাজারে আসে, তখন এটির হওয়ার কথা ছিল ধূমপানের ‘নিরাপদ’ ও ‘স্বাস্থ্যকর’ বিকল্প। এটি যারা বাজারে এনেছিল, তারা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল যে এটি হবে সিগারেট ছাড়ার পথ।

তবে প্রায় এক দশক পর, বিজ্ঞান এখন বলছে ভিন্ন কথা। ভেপ (vape) বা ই-সিগারেট এখন আর ‘ধোঁয়ার বিকল্প’ নয়, বরং এটি নিজেই এক স্বাস্থ্য হুমকিতে পরিণত হয়েছে। অন্তত সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণায় সেরকম তথ্যই উঠে এসেছে।

ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, গবেষকরা বিদ্যমান ভেপের ওপর গবেষণা করে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তার আগেই বাজার ছেয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন সংস্করণে।

স্বপ্ন শুরু হয়েছিল ভালো কিছু দিয়ে

২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে তরুণ প্রজন্মের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ছোট আকৃতির ভেপ ডিভাইস।

বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল- এতে টার নেই, টক্সিন নেই, আগুন নেই। দাম তুলনামূলক কম, গন্ধও নেই, ফ্লেভার আছে প্রচুর। এক কথায়, তরুণদের আকৃষ্ট করার মতো সব উপাদানই যেন এতে ছিল।

কিন্তু এখন গবেষকরা বলছেন—এই ধোঁয়ার ফাঁকে যে বিপদ লুকিয়ে আছে, তা যত দিন যাচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে।

হৃদযন্ত্রের জন্য তাৎক্ষণিক চাপ

গবেষণায় দেখা গেছে, ভেপের একবারের টানেই হৃদযন্ত্রের উপর চাপ পড়ে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, রক্তনালিগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ে—যার ফলে সময়ের সঙ্গে হৃদপিণ্ডের ধমনিগুলো শক্ত হয়ে যেতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন স্কুল অব মেডিসিনের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জেমস এইচ স্টেইন এ প্রসঙ্গে বলেন, “যদি কেউ সারা দিন ধরে বারবার ভেপ টানে, সে একপ্রকার উচ্চ রক্তচাপে দিন কাটায়”।

ভেপের তরলগুলো উচ্চ তাপে উত্তপ্ত হলে সেখান থেকে নির্গত হয় ক্ষতিকর রাসায়নিক, যা ফুসফুস হয়ে রক্তে মিশে যায়, পরে সোজা চলে যায় হৃদপিণ্ডে। যেমন—ফরমালডিহাইড ও অ্যাসিট্যালডিহাইড। এই উপাদানগুলো ক্যানসারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তবে এখন পর্যন্ত ভেপের কারণে ক্যানসার হয়েছে কি না, তা একেবারে স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। এ বিষয়ে আরও সময় ও গবেষণা প্রয়োজন বলেই জানিয়েছেন গবেষকরা।

গবেষকরা বলছেন, ক্যানসার বিকশিত হতে সময় লাগে। এ কারণেই এতো অল্প সময়ের মধ্যে তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে এটুকু তারা নিশ্চিত যে ভেপ থেকে নির্গত কিছু উপাদান ক্যানসারের ঝুঁকি বহন করে।

ভেপ মানেই নিরাপদ নয়

এদিকে, ইউনিভার্সিটি অফ রচেস্টার মেডিসিনের গবেষক ইরফান রহমান জানাচ্ছেন, ভেপের এই রাসায়নিকগুলো শুধু রক্তনালিতে ক্ষতি করে না, বরং সারা শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—ভেপ ছাড়তে গেলে অনেকেই অভিজ্ঞতা পান নিকোটিন উইথড্রয়ালের। এক কথায় সিগারেট ছাড়তে যে কষ্ট হয়, প্রায় একই রকম কষ্ট হয় ভেপ ছাড়তে গেলেও। তখনও হৃদযন্ত্রে বাড়তি চাপ পড়ে, রক্তচাপ বেড়ে যায়, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।

ফুসফুসের ক্ষতি: যেটা এখনও পুরোটা জানা হয়নি

ভেপ ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে বলে গবেষণায় জানা গেছে। এই প্রদাহ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যেতে পারে। যাদের হাঁপানি বা সিওপিডি রয়েছে, তাদের জন্য এটি বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করে। অনেকেই দীর্ঘস্থায়ী কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভোগেন।

এ ছাড়া ক্যানসারের সঙ্গে যুক্ত উপাদান তো ভেপ থেকে নির্গত হয়ই। বিশেষ করে তিনটি জনপ্রিয় ডিসপোজেবল ভেপ নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার ইউসি ডেভিস-এর গবেষক ব্রেট পুলিনের দল গবেষণা করে দেখেছেন যে এগুলো থেকে নির্গত হয় উচ্চমাত্রার নিকেল ও অ্যান্টিমনি, যেগুলো ফুসফুস ক্যানসারের সঙ্গে যুক্ত।

তাদের আরেকটি উদ্বেগজনক আবিষ্কার—ভেপ থেকে অনেক সময় নিঃসৃত হয় লিড (সীসা), যা এক ভয়াবহ নিউরোটক্সিন।

ফ্লেভারের আড়ালে বিপদ

বিশেষত ফ্লেভারযুক্ত ডিসপোজেবল ভেপে যে রাসায়নিক ব্যবহার হয়, সেগুলো কোষের মেমব্রেন নষ্ট করতে পারে। এতে কেবল ফুসফুস নয়, হৃদরোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

ড. স্টেইন বলেন, ‘ফ্লেভারের জন্য ব্যবহৃত কিছু উপাদান এতটাই ক্ষতিকর যে, কোষের গঠনই নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি হৃদপিণ্ড পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”

আর এক ভয়াবহ দিক—‘পপকর্ন লাং’। এটি একটি বিরল অবস্থা, যেখানে ফুসফুসে চিরস্থায়ী দাগ পড়ে যায় এবং শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এটি হয় মূলত ডায়াসেটাইল নামে এক যৌগের কারণে। বেশ কিছু ফ্লেভার ভেপে এটি ব্যবহৃত হয়। যদিও বড় বড় কোম্পানিগুলো এখন বলছে, তারা ওই যৌগ এখন আর ভেপে ব্যবহার করে না।

ভিটামিন ই অ্যাসিটেট ব্যবহার করা ভেপের কারণে ফুসফুসের গুরুতর ক্ষতি হয়েছে এমন তথ্য উঠে এসেছিল ২০১৯ সালের গবেষণায়। সেবার যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ৬৮টি মৃত্যুর ঘটনাও রেকর্ড হয়েছিল। ২০১৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২ হাজার ৮০৭ জনকে এই উপাদানের কারণে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিল।

মুখ ও দাঁতের স্বাস্থ্যও হুমকির মুখে

নিকোটিনের কারণে রক্ত সঞ্চালন কমে যায় দাঁতের মাড়িতে। এতে মাড়ি দুর্বল হয়ে পড়ে, সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ে।

ড. রহমান জানাচ্ছেন, ভেপেও রয়েছে একই রকম ঝুঁকি। নিকোটিন দাঁতের মাড়ি ও আশপাশের টিস্যুকে ধ্বংস করতে পারে।

ফলে মুখ ও দাঁতের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ভেপও ঘুরেফিরে সিগারেটের মতো একই ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।

আসক্তি: নতুন প্রজন্মের নতুন অভ্যাস

ইউসি সান ফ্রান্সিসকো টোব্যাকো কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ড. পামেলা লিং জানান, তিনি এমন অনেক কিশোরকে দেখেছেন যারা ভেপ নিয়ে ঘুমায়। ঘুম ভাঙার পর তাদের প্রথম কাজই হলো—ভেপে একটা টান দেওয়া।

গবেষণা বলছে, ই-সিগারেট আসক্তিকর। আর কিশোর বয়সেই এই অভ্যাস তৈরি হলে, তা মস্তিষ্কের বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে।

অনেকের জন্য ভেপ ছাড়ার প্রক্রিয়া কষ্টকর হয়ে উঠে। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, রাগ, অবসাদের মতো বিষয়গুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

আরও বিপদের খবর হলো, এখন বাজারে এমন ভেপ এসেছে, যেগুলোর একটি ডিভাইসে ২০,০০০ পাফ থাকে, যা প্রায় ১০০ প্যাকেট সিগারেটের সমান নিকোটিন!

ড. লিং বলেন, “নতুন প্রোডাক্ট এত দ্রুত বাজারে আসে যে, বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে করতেই আরও নতুন ভেপ চলে আসে।”

ভেপ কি সিগারেটের তুলনায় নিরাপদ?

অনেকেই ভাবেন, “সিগারেট নয় তো, ভেপ করছি”—তাই সমস্যা নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যেখানে ২০২১ সালে ৪.৫ শতাংশ নিয়মিত ভেপ ব্যবহার করতেন, সেখানে ২০২৪ সালের এক জরিপ বলছে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী বিগত এক মাসে ভেপ ব্যবহার করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতই সময় গড়াচ্ছে, ভেপ নিজেই হয়ে উঠছে নতুন ঘরানার এক ধূমপানের সংস্কৃতি।

“আপনার মা যা বলতেন, সেটাই সত্যি”

সবশেষে ড. স্টেইনের কথাই বোধহয় সবচেয়ে বাস্তবসম্মত। তিনি বলছেন, “আপনার মা যা বলতেন, সেটাই সত্যি। সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝে নেওয়ার কথা—তীব্র তাপে উত্তপ্ত রাসায়নিক ধোঁয়া যেটা আপনি ফুসফুসে নিচ্ছেন, সেটা ভালো কিছু তো হবে না!”

গবেষণা যতো করা হচ্ছে, ততোই স্পষ্ট হচ্ছে—ভেপ সিগারেটের বিকল্প হতে পারে, কিন্তু ‘নিরাপদ’ বা ‘স্বাস্থ্যকর’ কিছু নয়। বরং এর নিজস্ব বিপদ ও ঝুঁকি আছে, যা মোটেও এড়িয়ে যাওয়ার মতো কিছু নয়, এড়িয়ে যাওয়ায় উচিত নয়।

তথ্যসূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস 

আপনার যদি এ লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে উইজ বাল্ব বুকমার্ক করে রাখুন। এরকম অভিনব ও নিত্যনতুন লেখা প্রায়ই পাবেন। আপাতত কষ্ট করে একটু ঢুঁ দিয়ে যেতে হবে সাইটে। চেষ্টা করছি নিউজলেটার অপশনও নিয়ে আসতে। সেটা চলে এলে সরাসরি আপনার মেইলেই চলে যাবে নতুন লেখা।